আগে আপনাকে ভালো লাগত, রামবাবু
এখন আপনি বদলে গেছেন।
কখনও কখনও আপনাকে কংগ্রেস মনে হত
কখনও সি.পি.এম
কখনও সি.পি.আই
মার্কিন সেনেটে আপনার নাম উঠেছিল
কিন্তু ভিয়েতনামের পক্ষে
আপনি বালিদ্বীপ পর্যন্ত ছুটে গেছেন।
বিহারের লছমনপুরে আপনাকে প্রথম দেখি
ততদিনে আপনার স্ত্রী আপনাকে ছেড়ে গেছেন
বিহারের গ্রাম
আপনি তো ভালোই জানেন, খুব সুবিধের জায়গা নয়
ওখানকার লোকেরা বলে
পাতাল প্রবেশ হল স্রেফ ধাপ্পা
আপনি নাকি
উত্তরপ্রদেশের গ্রামে একটা কুয়োর ভেতর
বউকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন।
এখনও সেই কুয়োর ভেতর বসে
মা সীতা কাঁদেন,
তখন গোটা বিহারের মেয়েরা
উত্তরপ্রদেশের মেয়েরা
রান্না করতে করতে কাঁদে
আর চোখ মছে।
আগে আপনাকে ভালো লাগত, রামবাবু
কত রাত্রে আমি না খেয়ে
মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছি
শুধু আপনার তীর ধনুকের গল্প শুনতে শুনতে।
ছোটবেলায় আপনার ভাইকেও আমার খুব ভালো লাগত
কী সুন্দর ভাই
এক ডাকে সাড়া দেয়
যে কোনও দরকারে দাদা বললে
ভাই একপায়ে খাড়া।
পরে বড় হয়ে দেখলাম
আপনার ভাই বীর হতে পারে তবে বড্ড মেনিমুখো
দাদার সমস্ত অর্ডার
সাপ্লাই দেওয়াতেই তার সুকৃতি।
আমি যদি আপনার ভাই হতাম
ও.বি.সি-দের মেরে ফেলার আগে বলতাম
দাদা, এ কাজ করিস না,
লঙ্কা পোড়ানোর আগে আমি বলতাম
ঠিক হচ্ছে না, দাদা, ফিরে চল।
আপনি এবং আপনার হনুমান
শুধু ভারতবর্ষে নয়
গোটা উপমহাদেশে হয়ে উঠলেন সোশ্যালিজম
মার্কস এঙ্গেলস এলেন
মাও-সে-তুং হো-চি-মিন এলেন
এল শিল্পায়ন পোখরান
কিন্তু আপনি এবং হনুমান এখনও পর্যন্ত
উত্তম-সুচিত্রার চেয়েও জনপ্রিয় জুটি।
কোভালাম বিচ থেকে বনগাঁর সেলুনে
আপনাদের জোড়া ক্যালেন্ডার।
আগে আপনাকে ভাল লাগত, রামবাবু
ত্রিপুরায় উপজাতিরা ঢুকে পড়ল
আপনি হনুমানকে দিয়ে খাদ্য পাঠালেন
মরিচঝাঁপি তৈরি হল
আপনি পানীয় জলের ব্যবস্থা করলেন
বাংলাদেশ থেকে পিল পিল করে পিপীলিকারা
চলে এল শিয়ালদায়
আপনি আপনার বৈমাত্রেয় বোন
ইন্দিরার পাশে দাঁড়ালেন, জলপাইগুড়িতে দাঁড়ালেন
অন্ধ্রে গিয়ে দাঁড়ালেন।
তখনও আপনি দাঁড়াতেন
আপনাকে নিয়ে লেখা
তুলসীদাসের রামচরিতমানস
আপনিও শুনতেন তখন
আপনার চোখেও বাষ্প ঘনিয়ে আসত।
কিন্তু এখন আপনি আর
আপনি নেই, আপনি
আদবানীকে ভুজুং দিচ্ছেন
জয়ললিতাকে ফুচুং।
পাকিস্তান নামে সবচেয়ে বড় বিষফোঁড়াটাকে বলছেন ফুসকুড়ি?
আমি বলব আপনিই নষ্টের গোড়া
বাল্মীকি আপনাকে যতই নরশ্রেষ্ঠ বলুক
নির্মল জলের মত বলুক
আমার সন্দেহ আছে
ওরা যখন অযোধ্যায় গেল
আপনার বাধা দেওয়া উচিৎ ছিল।
বম্বে থেকে বাঙালিকে ধরে ধরে
ফেরত পাঠাল মহারাষ্ট্র
তাহলে উড়িষ্যা থেকে মালয়ালিদের
ফেরত পাঠাক কলিঙ্গরাজ।
কর্ণাটক থেকে তামিলদের
পাঞ্জাব থেকে মারাঠিদের।
সারা দেশ জুড়ে লেগে যাক ফেরত আর ফেরত
এই ফেরত দেওয়ার মারি ও মড়ক
আপনি সামলাতে পারবেন, রামবাবু?
বনে থাকার দিনগুলো ভুলে যাবেন না
আপনার বাবার ভুলের জন্য
মনে মনে আপনি বাবাকে ক্ষমা করেননি কোনও দিন
আমি জানি
জঙ্গলে থাকতে আপনার ভালো লাগত না
সেই খারাপ দিনগুলো আপনি মনে করুন
তারও চেয়ে খারাপ দিন
আমাদের সামনে, আপনার হাত কাঁপছে না, ভয় করছে না
আপনার নামে ভারতবর্ষে
হাজার হাজার বালকের নাম
তারা বড়বাজারে, মেটিয়াবুরুজে, চাঁদনিচকের
দোকানে দোকানে কাজ করে
দিনান্তে বাড়িতে আটা কিনে নিয়ে যায়
ধোঁয়াভর্তি উনুনে বসে
তাদের মা রুটি ভেজে দেয়।
সারা ভারতবর্ষ জুড়ে
সন্ধে সাড়ে আটটায় কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে
যে বালকেরা এখন
দুটো রুটি নিয়ে বসেছে খাবে বলে
তাদের কে রাম কে রহিম
সেটা আপনার দেখার কথা ছিল না
বাল্মীকির সাথে দেখা হলে বলবেন
রামায়ণের পরবর্তী সংস্করণের আগে
অর্থাৎ প্রেসে পাঠাবার আগে
উনি যেন নতুন করে আর একবার লিখে দেন ।
সমস্ত সকালবেলা ধরে কারা আমাদের হারানো দিনের-গল্প বলে গেলো
সমস্ত সকালবেলা ধরে কারা আমাদের উঠতে বললো না
কেবল বললো বসে বসে শোনো তোমরা
তোমাদের সেই দিনগুলি যা তোমরা পিছনে ফেলে রেখে এসেছিলে
. তা কেউ কুড়িয়ে নেয়নি আর
তুমি টাকা হারিয়ে এসো, পিছন থেকে কুড়িয়ে নেয় অনেকে
পথ হারিয়ে এসো তুমি, সে-পথেই সারিবদ্ধ পথিক চলেছে
মৃতদেহ ফেলে রেখে এসো তুমি, — শকুন শৃগালে ভোগ করেছে মাংস
দরজা খুলে রেখে এসো তুমি—ত্রস্ত মেয়েমানুষ নিয়েছে পিতলের বাসন
বাড়ি ফেলে রেখে এশো তুমি— সমস্ত নৈরেকার, সকলি নৈরেকার !
তুমি ছেঁড়া জামা দিয়েছো ফেলে
ভাঙা লন্ঠন, পুরোনো কাগজ, চিঠিপত্র, গাছের পাতা—
. সবই কুড়িয়ে নেবার জন্যে আছে কেউ
তোমাদের সেই হারানো দিনগুলি কুড়িয়ে পাবে না তোমরা আর |
তোমরা যতো যাবে ততোই যাবে মৃত্যুর দিকে
বোঝাবে সকলে – ঐ তো জীবন, ঐ তো পূর্ণতা, ঐ তো সর্বাঙ্গীন সর্বাবয়ব
ঐ তো যাকে বলে সমাজ, ধর্ম, সাহিত্য, ধ্যান, পরমার্থ বিষাদ—
সমস্ত সকালবেলা ধরে কারা আমাদের হারানো দিনের গল্প বলে গেলো
তারা কোথা থেকে পেয়েছো বলে গেলো না
স্বীকার করলো না তারা পথ থেকে চুরি করেছে কিনা আমাদের
. সেই হারানো স্বপ্নগুলি, স্মৃতিগুলি
তারা আমাদের বলে গেলো হারানো দিনের সেই অনুপম স্বপ্নগুলি স্মৃতিগুলি
আমরা অনুভব করলাম আবার—সেইসব হারানো গল্প
. যা আমরা এতাবত্কাল হারিয়ে এসেছি
হারিয়ে এসেছি বনে-প্রান্তরে পুরানো খাতার শ্লেটে রাসতলায়
নদীসমুদ্রে বেলাভূমিতে পথে ডালে-ডালে টকি হাউসে
হারিয়ে এসেছি ইস্টিশানে খেয়াঘাটে কলকাতার গ্রামে গ্রামে
কারুর চুলে কারুর মুখে চোখে কারুর অঙ্গীকারে—
হারিয়ে এসেছি হারিয়ে এসেছি হারিয়ে এসেছি – ফিরে পাবো না
. জেনে কখনো আর
কখনো ফিরে পাবো না সেইসব দিন যা ঝড়-বৃষ্টি-রৌদ্রে হেমন্তে ভরা
সেইসব বাল্যকালের নগ্নতার কান্নার পয়সা-পাবার-দিন
. ফিরে পাবো না আর
ফিরে পাবো না আর কাগজের নৌকা ভাসাবার দিন উঠানের
. ক্ষণিক সমুদ্রের কলরোলে
ফিরে পাবো না আর ফিরে পাবো না আর ফিরে পাবো না আর
সেইসব জ্যোত্স্নার ঝরাপাতার কথকতার দিন ফিরে পাবো না আর |
সমস্ত সকালবেলা ধরে কারা আমাদের সেইসব হারানো দিনগুলির
. কথা বলে গেলো
সকালবেলা তাই আমাদের কোনও কাজ হয়নি করা
আমরা অনন্তকাল এমনি চুপচাপ হারানো দিনের গল্প শুনছিলাম
. পুলিশের মতো
আমরা আমাদের কর্তব্য স্থির করছিলাম পুলিশের মতো
আমরা ভাবছিলাম সেইসব হারানো দিনগুলি ফিরে পাবার জন্য
. লাকি মিতাকে পাঠিয়ে দেখবো একবার
আমরা বসে বসে এলোমেলো উত্তাল সম্ভাবনার স্বপ্নে এমনি করে
. ব্যস্ত রাখছিলাম আমাদের
আমরা এমনি করে সময়ের একের পর এক চড়াই-উৎরাই হচ্ছিলাম পার
এমন সময় তারা বললো—‘গাড়ি’ এসে গেছে, উঠে পড়ো উঠে পড়ো –
এখানে থাকলে বাঘে খাবে তোমাদের’
আমরা তখনই লাফিয়ে লাফিয়ে অনেকে হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে
. ভবিষ্যৎ-গাড়ির দিকে চলে গেলাম
আমরা সকলেই এখানে বাঘের জিহ্বা এড়িয়ে গিয়ে ওখানের বাঘের
. জিহ্বার দিকে চলে গেলাম |
বৃষ্টি বৃষ্টি
জলে জলে জোনাকি
আমি সুখ যার মনে
তার নাম জানো কী ?
মেঘ মেঘ চুল তার
অভ্রের গয়না
নদী পাতা জল চোখ
ফুলসাজ আয়না।
বৃষ্টি বৃষ্টি
কঁচুপাতা কাঁচ নথ
মন ভার জানালায়
রাতদিন দিনরাত।
ঘুম নেই ঘুম নেই
ছাপজল বালিশে
হাঁটুভাঙা নোনা ঝিল
দুচোখের নালিশে।
বৃষ্টি বৃষ্টি
জলেদের চাঁদনি
দে সোনা এনে দে
মন সুখ রোশনি।
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।
আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা
আত্মায় অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দ
শৈশব থেকে বিষণ্ণ দীর্ঘশ্বাস
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরধী করে দেয়-
বলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা
তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর
তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে
নেমে গেছে
শুকনো রক্তের রেখা
চোখ দুটি চেয়ে আছে।
সেই দৃষ্টি এক গোলার্ধ থেকে
ছুটে আসে অন্য গোলার্ধে
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।
শৈশব থেকে মধ্য যৌবন পর্যন্ত দীর্ঘ দৃষ্টিপাত
আমারও কথা ছিল হাতিয়ার নিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবার
আমারও কথা ছিল জঙ্গলে কাদায় পাথরের গুহায়
লুকিয়ে থেকে
সংগ্রামের চরম মুহূর্তটির জন্য প্রস্তুত হওয়ার।
আমারও কথা ছিল রাইফেলের কুঁদো বুকে চেপে প্রবল হুঙ্কারে
ছুটে যাওয়ার।
আমারও কথা ছিল ছিন্নভিন্ন লাশ ও গরম রক্তের ফোয়ারার মধ্যে
বিজয়-সঙ্গীত শোনাবার-কিন্তু আমার অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছে!
এতকাল আমি এক, আমি অপমান সয়ে মুখ নীচু করেছি
কিন্তু আমি হেরে যাই নি, আমি মেনে নিই নি
আমি ট্রেনের জানলার পাশে, নদীর নির্জন রাস্তায়,
ফাঁকা মাঠের আলপথে, শ্মশানতলায়
আকাশের কাছে, বৃষ্টির কাছে, বৃক্ষের কাছে,
হঠাৎ-ওঠা ঘূর্ণি ধুলোর ঝড়ের কাছে
আমার শপথ শুনিয়েছি, আমি প্রস্তুত হচ্ছি, আমি
সব কিছুর নিজস্ব প্রতিশোধ নেবো।
আমি আবার ফিরে আসবো।
আমার হাতিয়ারহীন হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে, শক্ত হয়েছে চোয়াল,
মনে মনে বারবার বলেছি, ফিরে আসবো!
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়-
আমি এখনও প্রস্তুত হতে পারি নি, আমার অনবরত
দেরি হয়ে যাচ্ছে
আমি এখনও সুড়ঙ্গের মধ্যে আধো-আলো ছায়ার দিকে রয়ে গেছি,
আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে চে,
তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়!
দেখেছিলেম যেদিন তোমায় অঝোর আলোর পরশে,
থাকতে আর পারি নি সেদিন একলা চুপটি বসে।
কী সন্দর সেজেছিলে!- যেন মায়া ভরা সেই মুখ,
ওই বদন এই লুকিয়ে আছে আমার সকল সুখ।
চুপি চুপি পায়ে হাঁটছিলাম তোমার আঁচল ধরে,
কি-বা শঙ্কায় উঠলে মেতে, ফুল গুলো গেল পড়ে।
সেই ফুল তো লাগিয়ে ছিলেম তোমার কানের পিঠে,
কেন আমায় ছেড়ে গেলে ওগো, হয়ে গেলে তুমি উধাও?
তবু ও এক অদৃশ্য টান কাছে ডাকতো বারংবার।
আমি ও যেতাম ছুট্টে চলে, সকল কার্য ফেলে,
তুমি ও দেখাতে অবহেলা, দিতে তাড়িয়ে হেসে-খেলে।
আমি তো জানতাম, তুমি যে হবে অন্য কারোর প্রিয়া,
সত্য জেনে ও তোমাকে ই কেন মন চাইতো?- বল হিয়া!
যেদিন তোমায় দেখেছিলেম অন্য কারোর সাথে,
তুমি ও ছিলে হাসি-খুশি, হাত রেখেছিলে তার হাতে।
সত্যি বলছি, সেদিনের পর কষ্ট হয়েছে অনেক,
সেই কষ্ট কে বুঝবে বলো?- তবু বুঝিয়েছি প্রতি জনেক।
তোমার পাশের কলঙ্কিত “আমি” টা না হয় মুছে যাক,
তোমায় প্রণয় অন্যের সাথে- অদেখা সত্য হয়ে ই থাক!
সেদিন আমার কাছে এলো এক সোনা রঙা লাল কার্ড,
তারিখ টা ছিল ভয়াবহ, আগস্ট মাসের থার্ড!
বর ছিল বুঝি “জুয়েল রানা”, কনে রূপে ছিলে তুমি,
জুয়েলের সাথে কবে ভাব জমালে?- বলো তো দেখি শুনি!
বিয়ের কার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, হতবাক হয়ে প্রায়,
কবে আমাকে ছেড়ে জুয়েল কে বর বানালে তোমার হায়!
বেলা গড়ায়, দিন পেরোয়, বিয়ের তারিখ ঘনিয়ে আসে,
আমার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত, কেউ ছিল না তখন পাশে।
মাইগ্রেনের ব্যথা নিয়ে বিয়ের কার্ড টা দেখি,
কী সুন্দর নিষ্পাপ ছিলে, আজ করলে তুমি একি!
তোমার সাথের মধুর স্মৃতি বিষের মতন ঠেকে,
আমার কলিজায় রয়েছিলে তুমি, প্রতি টা বাঁকে বাঁকে।
আজ সবকিছু দুর্বিষহ, জীবন থমকে গেছে,
তোমার বিয়ে তে অ্যাট্যান্ড করা ছাড়া, আর কী-বা করার আছে?
অবশেষে এলো সেই দিনটি, আগস্ট মাসের থার্ড,
তোমাকে অন্যের বধূ হিসেবে দেখা ছিল খুব হার্ড।
কিন্তু কই! বিয়ে তে গেলাম, জুয়েল রানা- সে কই?
আমার দু’জন ই তোমাকে চেয়েছি, তাই পরিচিত ও হই।
আমাকে দেখে ই হেসে দিলে তুমি, কী মায়াময় সেই হাসি,
হাসি দেখলে ই মন টা চায়, আরো বেশি বেশি ভালোবাসি।
কিন্তু কী আর করার?- তুমি হবে এখন অন্য কারোর বউ,
তুমি তো জনাব জুয়েল রানার, আমার তো আর নও!
আমায় দাঁড়াতে বলে তুমি, কোথায় যে চলে গেলে?!
আমাকে আবার হেয় করলে, ছেড়ে গেলে মোরে ফেলে।
ফিরে আসলে- হাতে কী যেন এক গোল বাক্স নিয়ে,
অর্ডার করলে- আমায় নাকি সাজতে হবে এইটা দিয়ে।
আমি তো হায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি তখন,
বক্সে ছিল- ধুতি, পাঞ্জাবি- খুলে দেখালে তুমি যখন।
আমার বললে- “বুদ্ধু তুমি, কিচ্ছু বোঝো না যে!
আমার বর তো তুমি ই ওগো, জুয়েল রানা ফের কে?”
আমি তো তখন বোকা বনে গেছি, কিচ্ছু বঝি না আর,
তুমি বললে, “প্র্যাঙ্ক ছিল এটা, করো না মুখ আর ভার।”
আমি বললাম, “এসব তবে কী সাজানো নাটক ছিল?”
তুমি বললে, “হ্যাঁ, গো মশাই, সাজানো নাটক ই ছিল।”
হাফ ছেড়ে বেঁচে আমি বললুম- “এসব করো না কভু আর।”
তুমি মিষ্টি স্বরে বললে, “না না, আরো করবো বার বার।”
তুমি ই আমার প্রথম প্রেম, তুমি ই আমার শেষ,
তোমার সাথে ই প্র্যাঙ্ক করবো, ভালো ই আছি বেশ।
প্রকৃতি হাতছানি দিয়ে ডাকে
হারাতে ইচ্ছে হয় পাহাড়ি নদীর বাঁকে,
দুর্গম পথ পেরিয়ে পাহাড় জয়ের নেশা
প্রকৃতির একান্ত সান্নিধ্যে নিজেকে ভালোবাসা।
বর্ষায় প্রপাতের সৌন্দর্য দেখার বড় স্বাদ
জুম ঘরে বসে বৃষ্টি দেখার আহ্লাদ,
পিচ্ছিল পাথুরে পথে দুঃসাহসিক অভিযান
দুর্গম বন পেরেবো হাতে নিয়ে প্রান।
পশু পাখির কলোরবে মুখরিত চারিধার
এখানে ফিরতে মন চায় বারংবার,
ক্লান্তি শেষে ঝিরির ঠান্ডা জল পান
একমুঠো জুৃম ভাতে দেহ ফিরে পায় প্রান।
চূড়োয় বসে নক্ষত্ররাজির মাঝে দিবো ডুব
এমন জোসনা রাত্রির সান্নিধ্য চাই খুব,
প্রকৃতি দেবী তোমার কোলে দিও ঠাই
তোমাকে জানার আশায় অজানাতে হারাই।
যদি শুষ্ক ভূমি হতে তুমি,
বৃষ্টি হয়ে তোমায় ভেজাতাম আমি।
আকাশের বিশালতা মাখতে যদি গায়ে,
সাগর হয়ে ছুয়ে দিতাম গুটিগুটি পায়ে।
সূর্যের মতো তেজে দীপ্ত যখন হবে
তোমার তেজস্বীতা আমায় পোড়াবে,
অমাবস্যায় যখন ছেয়ে যাবে মন
চাঁদের হাসি এনে দেব; অভিমান বারণ।
শিমুল হয়ে ঝরতে রাজি যদি তুও চাও
কাঠগোলাপ ভেবে আমায় ছুয়ে দাও,
তৃষ্ণা মেটাতে তোমার হতে পারি ঝর্না
তোমার মেটাতে স্বাদ হবো অন্নপূর্ণা।
হরিৎ বনে চলো গড়বো কুড়ে-
শান্তির ঠিকানা, হারাবো নীড়ে;
প্রকৃতি প্রেমের মতো ভালোবাসো আমায়
তৃষ্ণার্ত এই বুকে আগলাবো তোমায়।
নীল শাড়িতে সাজবে রূপা, হলুদ হিমু আমি
আনবো কিনে রেশমী চুড়ি হয়ে তোমার প্রেমী,
হুডফেলা রিকশা চড়ে ঘুরবো দুজন খুব
এলোচুলের মোহতে পড়ে তোমাতে দেবো ডুব।
নিজের হাতে পড়িয়ে দেবো পায়েল তোমার পায়ে
কাশফুলেরা কাটবে বিলি তোমার কোমল গায়ে,
বৃষ্টি এলে ভিজবো দুজন, পড়বো তোমার মোহে
চিরকুটের আদান-প্রদান নিত্যনতুন বইয়ে!
টং এর চায়ে উষ্ণ হবো, দৃষ্টিতে হাতছানি
ছয় তারেতে উঠবে সুর, তোমায় ঠিকই জানি,
চোখের পাতায় ভিড় করেছে, স্বপ্ন আরও কতো-
তোমার মোহে বন্দি আমি, তোমার খুশির ব্রত।
তোমার চোখে আমায় দেখি, স্বপ্নসুরা পান
হাতের সাথে হাত ছুয়েছে, সঙ্গীতেরই তান;
কুঞ্জবনের রাসলীলাতে যেন কৃষ্ণ-রাধা
যমুনাতে ভেসে যাবে পথের যতো বাধা।
পূর্নিমাতে চন্দ্রবিলাস – সবার অজান্তে
প্রেমের ভেলায় খুনসুটিতে মাতবো একান্তে,
বৃষ্টিবিলাস-সূর্যস্নান বাদ যাবে না কিছু
মাতাল হাওয়ার মতো আমি ছুটবো তোমার পিছু।
রংধনুর সাত রঙেতে রাঙাবো তোমায়
অহর্নিশি থাকবে তুমি মোর ভাবনায়,
দেবদাসের পারো কিংবা হিমু-রূপা নয়
রাধিকার কাহ্নাই হয়ে বিশ্ব করবো জয়।
দূর পাহাড়ে ঘুরতে যাবো প্রিয়া তোমার সাথে
জুম ঘরেতে বসে দুজন দেখবো আকাশ রাতে,
চলার পথে ক্লান্ত হয়ে তাকাবে আমার পানে
এক পলকেই বুঝে নেবো চোখের ভাষার মানে।
আকবো আমি চিত্র তোমার মোনালিসার মতো
তোমার পায়ে লুটাবো আমি- প্রেম আছে যতো
তোমার জন্যে শব্দজালের মোহ হবে লেখা
প্রকৃতির সৌন্দর্য সব তোমায় নিয়েই দেখা।
তোমার জন্যে লিখবো গান, অনন্য সব সুর
ভুল করেও তোমায় আমি দেবোনা হতে দূর,
আরতিতে তুমিই দেবী, অঞ্জলিতেও তুমি
তোমার মাঝেই পূর্ণ হবো, অপূর্ন এই আমি।
চায়ের কাপে উঠবে ঝড়, তর্ক হবে খুব-
দিনের শেষে শ্রান্তি পেতে তোমার মাঝেই ডুব
রাজনীতির আলাপ কিংবা খেলার মাঠের লড়াই
তোমার মতো প্রেমী পেয়ে করতে পারি বড়াই।
সত্যজিৎ আর হুমায়ুনে যদিও বাধে গোল
দাবার প্রতি চালের সাথে পাল্টে প্রেমের ভোল।
ভিঞ্চি থেকে জয়নুল পর্যন্ত বাদ যাবে না কেউ
হৃদয়েতে চ্যাপলিন বসে- প্রনয়ে শিল্পের ঢেউ।
রুদ্র আর রবি ঠাকুরের বেজায় সদ্ভাব
আমাদের জুটি যেন তাদেরই প্রভাব;
বাচ্চুর “সেই তুমি”, জেমসের “কবিতা”
আমাদের প্রেম ঠিক শরৎ এর পরিনীতা।
এক রাজার দুই রানী, দুও আর সুও। রাজবাড়িতে সুওরানীর বড়ো আদর, বড়ো যত্ন। সুওরানী সাতমহল বাড়িতে থাকেন। সাতশো দাসী তাঁর সেবা করে, পা ধোয়ায়, আলতা পরায়, চুল বাঁধে। সাত মালঞ্চের সাত সাজি ফুল, সেই ফুলে সুওরানী মালা গাঁথেন। সাত সিন্দুক-ভরা সাত-রাজার-ধন মানিকের গহনা, সেই গহনা অঙ্গে পরেন। সুওরানী রাজার প্রাণ।
আর দুওরানী— বড়োরানী, তাঁর বড়ো অনাদর, বড়ো অযত্ন। রাজা বিষ নয়নে দেখেন। একখানি ঘর দিয়েছেন— ভাঙাচোরা, এক দাসী দিয়েছেন— বোবা-কালা। পরতে দিয়েছেন জীর্ণ শাড়ি, শুতে দিয়েছেন— ছেঁড়া কাঁথা। দুওরানীর ঘরে রাজা একটি দিন আসেন, একবার বসেন, একটি কথা কয়ে উঠে যান।
সুওরানী— ছোটোরানী, তারই ঘরে রাজা বারোমাস থাকেন।
একদিন রাজা রাজমন্ত্রীকে ডেকে বললেন— মন্ত্রী, দেশবিদেশ বেড়াতে যাব, তুমি জাহাজ সাজাও।
রাজার আজ্ঞায় রাজমন্ত্রী জাহাজ সাজাতে গেলেন। সাতখানা জাহাজ সাজাতে সাত মাস গেল। ছ’খানা জাহাজে রাজার চাকরবাকর যাবে, আর সোনার চাঁদোয়া-ঢাকা সোনার জাহাজে রাজা নিজে যাবেন।
মন্ত্রী এসে খবর দিলেন— মহারাজ, জাহাজ প্রস্তুত।
রাজা বললেন— কাল যাব।
মন্ত্রী ঘরে গেলেন।
ছোটোরানী— সুওরানী রাজ-অন্তঃপুরে সোনার পালঙ্কে শুয়েছিলেন, সাত সখী সেবা করছিল, রাজা সেখানে গেলেন। সোনার পালঙ্কে মাথার শিয়রে বসে আদরের ছোটোরানীকে বললেন— রানী, দেশ-বিদেশ বেড়াতে যাব, তোমার জন্য কী আনব?
রানী ননীর হাতে হীরের চুড়ি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললেন— হীরের রঙ বড়ো শাদা, হাত যেন শুধু দেখায়। রক্তের মতে রাঙা আট-আট গাছ মানিকের চুড়ি পাই তো পরি।
রাজা বললেন— আচ্ছা রানী, মানিকের দেশ থেকে মানিকের চুড়ি আনব।
রানী রাঙা পা নাচিয়ে নাচিয়ে, পায়ের নূপুর বাজিয়ে বাজিয়ে বললেন— এ নূপুর ভালো বাজে না। আগুনের বরন নিরেট সোনার দশ গাছা মল পাই তো পরি।
রাজা বললেন— সোনার দেশ থেকে তোমার পায়ের সোনার মল আনব।
রানী গলার গজমতি হার দেখিয়ে বললেন— দেখ রাজা, এ মুক্তো বড়ো ছোটো, শুনেছি কোন দেশে পায়রার ডিমের মতো মুক্তো আছে, তারি একছড়া হার এনো।
রাজা বললেন— সাগরের মাঝে মুক্তোর রাজ্য, সেখান থেকে গলার হার আনব। আর কী আনব রানী?
তখন আদরিনী সুওরানী সোনার অঙ্গে সোনার আঁচল টেনে বললেন— মা গো, শাড়ি নয় তো বোঝা! আকাশের মতো নীল, বাতাসের মতো ফুরফুরে, জলের মতো চিকন শাড়ি পাই তো পরে বাঁচি।
রাজা বললেন— আহা, আহা, তাই তো রানী, সোনার আঁচলে সোনার অঙ্গে ছড় লেগেছে, ননীর দেহে ব্যথা বেজেছে। রানী, হাসিমুখে বিদায় দাও, আকাশের মতো নীল, বাতাসের মতো ফুরফুরে, জলের মতো চিকন শাড়ি আনিগে।
ছোটোরানী হাসিমুখে রাজাকে বিদায় করলেন।
রাজা বিদায় হয়ে জাহাজে চড়বেন— মনে পড়ল দুখিনী বড়োরানীকে।
দুওরানী— বড়োরানী, ভাঙা ঘরে ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে কাঁদছেন, রাজা সেখানে এলেন।
ভাঙা ঘরের ভাঙা দুয়ারে দাঁড়িয়ে বললেন— বড়োরানী, আমি বিদেশ যাব। ছোটোরানীর জন্যে হাতের বালা, গলার মালা, পায়ের মল, পরনের শাড়ি আনব। তোমার জন্যে কী আনব? বলে দাও যদি কিছু সাধ থাকে।
রানী বললেন— মহারাজ, ভালোয় ভালোয় তুমি ঘরে এলেই আমার সকল সাধ পূর্ণ হয়। তুমি যখন আমার ছিলে তখন আমার সোহাগও অনেক ছিল, সাধও অনেক ছিল। সোনার শাড়ি অঙ্গে পরে সাতমহল বাড়িতে হাজার হাজার আলো জ্বালিয়ে সাতশো সখীর মাঝে রানী হয়ে বসবার সাধ ছিল, সোনার পিঞ্জরে শুক-শারীর পায়ে সোনার নূপুর পরিয়ে দেবার সাধ ছিল। মহারাজ, অনেক সাধ ছিল, অনেক সাধ মিটেছে। এখন আর সোনার গহনায় সোনার শাড়িতে কী কাজ? মহারাজ, আমি কার সোহাগে হীরের বালা হাতে পরব? মোতির মালা গলায় দেব? মানিকের সিঁথি মাথায় বাঁধব? মহাবাজ, সেদিন কি আর আছে! তুমি সোনার গহনা দেবে, সে সোহাগ তো ফিরে দেবে না! আমার সে সাতশো দাসী সাতমহল বাড়ি তো ফিরে দেবে না! বনের পাখি এনে দেবে, কিন্তু, মহারাজ, সোনার খাঁচা তো দেবে না! ভাঙা ঘরে সোনার গহনা চোর-ডাকাতে লুটে নেবে, ভাঙা খাঁচায় বনের পাখি কেন ধরা দেবে? মহারাজ, তুমি যাও, যাকে সোহাগ দিয়েছ তার সাধ মেটাও গে, ছাই সাধে আমার কাজ নেই।
রাজা বললেন— না রানী, তা হবে না, লোকে শুনলে নিন্দে করবে। বল তোমার কী সাধ?
রানী বললেন— কোন লাজে গহনার কথা মুখে আনব? মহারাজ, আমার জন্যে পোড়ারমুখ একটা বাঁদর এনো।
রাজা বললেন— আচ্ছা রানী, বিদায় দাও।
তখন বড়োরানী— দুওরানী ছেঁড়া কাঁথায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে রাজাকে বিদায় দিলেন। রাজা গিয়ে জাহাজে চড়লেন।
সন্ধ্যাবেলা সোনার জাহাজ সোনার পাল মেলে অগাধ সাগরের নীল জল কেটে সোনার মেঘের মতো পশ্চিম মুখে ভেসে গেল।
ভাঙা ঘরে দুওরানী নীল সাগরের পারে চেয়ে, ছেঁড়া কাঁথায় পড়ে রইলেন। আর আদরিনী সুওরানী সাতমহল অন্তঃপুরে, সাতশো সখীর মাঝে, গহনার কথা ভাবতে ভাবতে, সোনার পিঞ্জরে সোনার পাখির গান শুনতে শুনতে, সোনার পালঙ্কে ঘুমিয়ে পড়লেন।
রাজাও জাহাজে চড়ে দুঃখিনী বড়োরানীকে ভুলে গেলেন। বিদায়ের দিনে ছোটোরানীর সেই হাসিহাসি মুখ মনে পড়ে আর ভাবেন— এখন রানী কী করছেন? বোধ হয় চুল বাঁধছেন। এবার রানী কী করছেন? বুঝি রাঙা পায়ে আলতা পরছেন। এবার রানী সাত মালঞ্চে ফুল তুলছেন, এবার বুঝি সাত মালঞ্চের সাত সাজি ফুলে রানী মালা গাঁথছেন আর আমার কথা ভাবছেন। ভাবতে ভাবতে বুঝি দুই চক্ষে জল এল, মালা আর গাঁথা হল না। সোনার সুতো, ফুলের সাজি পায়ের কাছে পড়ে রইল; বসে বসে সারা রাত কেটে গেল, রানীর চোখে ঘুম এল না।
সুওরানী— ছোটোরানী রাজার আদরিনী, রাজা তারই কথা ভাবেন। আর বড়োরানী রাজার জন্যে পাগল, তার কথা একবার মনেও পড়ে না।
এমনি করে জাহাজে দেশ-বিদেশে রাজার বারো-মাস কেটে গেল।
তেরো মাসে রাজার জাহাজ মানিকের দেশে এল।
মানিকের দেশে সকলই মানিক। ঘরের দেওয়াল মানিক, ঘাটের শান মানিক, পথের কাঁকর মানিক। রাজ সেই মানিকের দেশে সুয়োরানীর চুড়ি গড়ালেন। আট হাজার মানিকের আটগাছি চুড়ি, পরলে মনে হয় গায়ের রক্ত ফুটে পড়ছে।
রাজা সেই মানিকের চুড়ি নিয়ে, সোনার দেশে এলেন। সেই সোনার দেশে স্যাক্রার দোকানে নিরেট সোনার দশগাছা মল গড়ালেন। মল জ্বলতে লাগল যেন আগুনের ফিন্কি, বাজতে লাগল যেন বীণার ঝংকার— মন্দিরার রিনি-রিনি।
রাজা মানিকের দেশে মানিকের চুড়ি নিয়ে, সোনার দেশে সোনার মল গড়িয়ে, মুক্তোর রাজ্যে এলেন।
সে দেশে রাজার বাগানে দুটি পায়রা। তাদের মুক্তোর পা, মানিকের ঠোঁট, পান্নার গাছে মুক্তোর ফল খেয়ে মুক্তোর ডিম পাড়ে। দেশের রানী সন্ধ্যাবেলা সেই মুক্তোর মালা গাঁথেন, রাতের বেলায় খোঁপায় পরেন, সকাল বেলায় ফেলে দেন।
রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা,
ভাবি নি সম্ভব হবে কোনোদিন।
আগে ওকে বারবার দেখেছি
লালরঙের শাড়িতে
দালিম ফুলের মতো রাঙা;
আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়,
আঁচল তুলেছে মাথায়
দোলনচাঁপার মতো চিকনগৌর মুখখানি ঘিরে।
মনে হল, কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব
ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চার দিকে,
যে দূরত্ব সর্ষেখেতের শেষ সীমানায়
শালবনের নীলাঞ্জনে।
থমকে গেল আমার সমস্ত মনটা;
চেনা লোককে দেখলেম অচেনার গাম্ভীর্যে।
হঠাৎ খবরের কাগজ ফেলে দিয়ে
আমাকে করলে নমস্কার।
সমাজবিধির পথ গেল খুলে,
আলাপ করলেম শুরু —
কেমন আছ, কেমন চলছে সংসার
ইত্যাদি।
সে রইল জানলার বাইরের দিকে চেয়ে
যেন কাছের দিনের ছোঁয়াচ-পার-হওয়া চাহনিতে।
দিলে অত্যন্ত ছোটো দুটো-একটা জবাব,
কোনোটা বা দিলেই না।
বুঝিয়ে দিলে হাতের অস্থিরতায় —
কেন এ-সব কথা,
এর চেয়ে অনেক ভালো চুপ করে থাকা।
আমি ছিলেম অন্য বেঞ্চিতে
ওর সাথিদের সঙ্গে।
এক সময়ে আঙুল নেড়ে জানালে কাছে আসতে।
মনে হল কম সাহস নয়;
বসলুম ওর এক-বেঞ্চিতে।
গাড়ির আওয়াজের আড়ালে
বললে মৃদুস্বরে,
“কিছু মনে কোরো না,
সময় কোথা সময় নষ্ট করবার।
আমাকে নামতে হবে পরের স্টেশনেই;
দূরে যাবে তুমি,
দেখা হবে না আর কোনোদিনই।
তাই যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে,
শুনব তোমার মুখে।
সত্য করে বলবে তো?
আমি বললেম, “বলব।”
বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়েই শুধোল,
“আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে,
কিছুই কি নেই বাকি।”
একটুকু রইলেম চুপ করে;
তারপর বললেম,
“রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে।”
খটকা লাগল, কী জানি বানিয়ে বললেম না কি।
ও বললে, “থাক্, এখন যাও ও দিকে।”
সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে;
আমি চললেম একা।