Archive

Category Archives for "সাহাবী"

আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ (রা:)

নাম আবদুল্লাহ, আবু মুহাম্মাদ কুনিয়াত। পিতা জাহাশ, মাতা উমায়মা। বিভিন্ন দিক দিয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্ক। মা উমায়মা বিনতু আবদিল মুত্তালিব রাসূলুল্লাহর (সা) ফুফু। বোন উম্মুল মু’মিনীন হযরত যয়নাব বিনতু জাহাশ রাসূলুল্লাহর (সা) স্ত্রী। তাই একাধারে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) ফুফাতো ভাই ও শ্যালক।

 

তাঁর জম্ম সন সম্পর্কে ইতিহাসে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে হিজরী তৃতীয় সনে উহুদের যুদ্ধে শাহাদাত বরণের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল চল্লিশ বছরের কিছু বেশী। এ তথ্যের উপর ভিত্তি করে বলা যায় রাসূলুল্লাহর (সা) নবুয়াত লাভের চব্বিশ/পঁচিশ বছর পূর্বে তিনি মক্কায় জম্ম গ্রহণ করেন। জাহিলী যুগে তিনি হারব ইবন উমাইয়্যার হালীফ (মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ) ছিলেন। তবে কেউ কেউ বনু আবদি শামসকে তাঁর হালীফ বলে উল্লেখ করেছেন। মূলতঃ দু’টি বর্ণনার মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কারণ, হারব ইবন উমাইয়্যা ছিল বনু আবদি শামসেরই একজন সদস্য।

 

হযরত আবদুল্লাহ ছিলেন ‘সাবেকীন ইলাল ইসলাম’ বা প্রথম ভাগে ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম। রাসূলুল্লাহ (সা) দারুল আরকামে আশ্রয় গ্রহণের পূর্বেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

ইসলাম গ্রহণের পর কুরাইশদের যুলুম-অত্যাচারের হাত থেকে তিনি ও তাঁর গোত্র রেহাই পাননি। এই কারণে দুইবার হাবশায় হিজরত করেন। শেষের হিজরাতে তাঁর পরিবারের সকল সদস্য অর্থাৎ দুই ভাই আবু আহমদ ও উবাইদুল্লাহ, তিন বোন যয়নাব, উম্মু হাবীবা, হামনা এবং উবায়দুল্লাহর স্ত্রী উম্মু হাবীবা বিনতু আবী সুফইয়ান তাঁর সঙ্গে ছিলেন। তাঁর ভাই উবায়দুল্লাহ হাবশায় পৌঁছে ইসলাম ত্যাগ করে খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে এবং মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) অবস্থায় সেখানে মারা যায়।

 

ইসলাম ত্যাগ করায় তার স্ত্রী উম্মু হাবীবা তাঁর থেকে পৃথক হয়ে যান এবং পরবর্তীকালে রাসূল (সা) তাঁকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা কান করেন। (আল ইসাবা ২/২৭২) হাবশায় কিছুকাল অবস্থানের পর হযরত আবদুল্লাহ পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে মক্কায় ফিরে আসেন। মক্কায় ফিরে এসে দেখেন তাঁর গোত্র বনু গানাম- এর সকল সদস্য ইসলাম গ্রহণ করেছেন। রাসূলুল্লাহর (সা) অনুমতি নিয়ে তিনি তাঁদের সকলকে সঙ্গে করে মদীনায় হিজরাত করেন।

তাঁদের পূর্বে কাবল হযরত আবু সালামা মদীনায় হিজরাত করেছিলেন। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, তাঁর গোত্রের সকলই ইসলাম গ্রহণ করেছলেন, তিনি গোত্রের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে সঙ্গে করেন মদীনায় পৌঁছেন। বনু গানামের একটি লোককেও তিনি মক্কায় ছেড়ে যাননি।

তাঁরা মক্কা থেকে যাত্রা করার কিছুক্ষণ পর কুরাইশ নেতৃবৃন্দ যথাঃ উতবা, আবু জাহল প্রমুখ ঘর থেকে বের হয়ে বনু গানামের মহল্লার দিকে যায়। তাদের উদ্দেশ্য, গানাম গোত্রের কে কে গেল, আর কে কে থাকলো এটাই দেখা। তারা দেখলো, গোটা মহল্লা জন-মানবহীন। কোন বাড়ীর দরজা খোলা, আবার কোনটা তালাবদ্ধ। এ অবস্থা দেখে উতবা মন্তব্য করলো ‘বনু জাহাশের বাড়ীগুলি তো খা খা করছে, তাদের অধিবাসীদের জন্য মাতাম করছে।

’ একথা শুনে আবু জাহল আবদুল্লাহ ইবন জাহাশের ঘরে হাত লাগালো। জিনিসপত্র ইচ্ছে মত লুটপাট করলো। গোটা মহল্লার মধ্যে আবদুল্লাহর ঘরটি ছিল সবচেয়ে সুন্দর ও প্রচুর্যময়। আব্দুল্লাহ রাসূলুল্লাহর নিকট তাঁর বাড়ীতে আবু জাহলের লুটপাটের কথা উল্লেখ করলে তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘আবদুল্লাহ, তুমি কি খুশী নও যে, এর বিনিময়ে আল্লাহ জান্নাতে তোমাকে একটি বাড়ী দান করবেন।’ জবাবে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়, ইয়া রাসূলুল্লাহ।’ রাসূল (সা) বললেন, ‘তুমি তাই লাভ করবে।’ আবদুল্লাহ খুশী হলেন।

 

মদীনা পৌঁছার পর আবদুল্লাহর গোটা খন্দানকে হযরত আসিম ইবন সাবিত আল-আনসারী আশ্রয় দান করেন। পরে রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের দু’জনের মধ্যে মুওয়াখাত বা ভ্রাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন।

হিজরী দ্বিতীয় সনের রজব মাসে রাসূল (সা) আটজন সাহাবীর একটি দলকে নির্বাচন করলেন। এই আট জনের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ ও সাদ ইবন আবী ওয়াক্কাসও ছিলেন। রাসূল (সা) সকলকে সম্বোধন করে বললেন, তোমাদের মধ্যে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় যে সর্বাধিক সহনশীল তাঁকেই তোমাদের আমীর বানাবো।

অতঃপর আবদুল্লাহকে তিনি আমীর মনোনীত করলেন। এভাবে তিনি মুমিনদের একটি দলের প্রথম আমীর হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। রাসূল (সা) তাঁকে যাত্রাপথ নির্দেশ করে তাঁর হাতে একটি সীল মোহর অঙ্কিত চিঠি দিয়ে বললেন, ‘দুই দিনের আগে এই চিঠিটি খুলবে না। দুইদিন পথ চলার পর খুলে পড়বে এবং এই চিঠির নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করবে।’

 

হযরত আবদুল্লাহ তাঁর সাথীদের নিয়ে মদীনা থেকে রওয়ানা হলেন। দুইদিন পথ চলার পর নির্দেশ মত চিঠিটি খুলে পড়লেন। চিঠিতে নির্দেশ ছিল, মক্কা ও তায়েফের মাঝখানে নাখলা নামক স্থানে পৌছে কুরাইশদের গতিবিধি ও অন্যান্য অবস্থা অবগত হবে। তিনি অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে এ হুকুম মাথা পেতে নিলেন।

সঙ্গীদের সম্বোধন করে তিনি বললেন, ‘বন্ধুগণ, আমি রাসূলুল্লাহর (সা) এ আদেশ কার্যকরী করে ছাড়বো। তোমাদের মধ্যে যে শাহাদাতের অভিলাষী সে আমার সাথে যেতে পারে, এবং যে তা পছন্দ না কর ফিরে যেতে পার। আমি কাউকে বাধ্য করবো না।’ এ ভাষণ শুনে সকল তাঁর সঙ্গী হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। নাখলা পৌঁছে তাঁরা কুরাইশদের গতিবিধির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতে লাগলেন।

একদিন কুরাইশদের একটি বাণিজ্য কাফিলা এই পথ দিয়ে অতিক্রম করছিল। এই কাফিলায় ছিল চার ব্যক্তি। ‘আমর ইবনুল হাদরামী, হাকাম ইবন কায়সান, উসমান ইবন আবদিল্লাহ এবং উসমানের ভাই মুগীরা। তাদের সাথে ছিল চামড়া, কিসমিস ইত্যাদি পণ্য সামগ্রী।

কাফিলাটি আক্রমণ করা না করা বিষয়ে আবদুল্লাহ ইবন জাহশ তাঁর সঙ্গীদের সাথে পরামর্শ করলেন। সেই দিনটি ছিল হারাম মাসসমূহের সর্বশেষ দিন। উল্লেখ্য যে, জুল কা’দা, জুল হিজ্জা, মুহাররম ও রজব- এ চারটি মাস হচ্ছে হারাম মাস। প্রচীন কাল থেকে আরবরা এ মাসগুলিতে যুদ্ধবিগ্রহ ও খুন-খারাবী নিষিদ্ধ বলে মনে করতো।

তাঁরা ভেবে দেখলেন, একদিকে আজ কাফিলাটি আক্রমণ করলে হারাম মাসে তা করা হবে। অন্যদিকে আজ আক্রমণ না করে আগামীকাল করলে কাফিলাটি মক্কার হারামের আওতায় পৌঁছে যাবে। মক্কার হারাম সকলের জন্য নিরাপদ স্থান। সেখানে তাদের আক্রমণ করলে হারাম কাজ করা হবে।

পরামর্শের পর তারা আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তাঁরা অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে কাফিলার নেতা ‘আমর ইবনুল হাদরামীকে হত্যা, উসমান ইবন আবদিল্লাহ ও হাকাম ইবন কায়সানকে বন্দী করেন এবং অন্যজন পালিয়ে যায়। তাঁরা প্রচুর পণ্যসামগ্রী গনীমাত হিসাবে লাভ করেন।

আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ অর্জিত গ্নীমাতের এক পঞ্চমাংশ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য রেখে দিয়ে অবশিষ্ট চার ভাগ তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে সমানভাবে বন্টন করে দেন। তখনও গনীমাত বন্টনের কোন নিয়ম-নীতি নির্ধারণ হয়নি। তবে আবদুল্লাহর এই ইজতিহাদ সঠিক হয়েছিল।পরে তাঁর এই সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে কুরআনে ‘খুমুস’ (পঞ্চমাংশ) –এর আয়াত নাযিল হয়।

হযরত আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ গনীমাতের এক পঞ্চমাংশ নিয়ে মদীনায় রাসূলুল্লাহর (সা) খিদমতে হাজির হলেন। রাসূল (সা) তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। তিনি বললেন, আমি তো তোমাকে ‘হারাম’ বা নিষিদ্ধ মাসে রক্তপাতের নির্দেশ দিইনি।

 

আবদুল্লাহর এই দুঃসাহস ও বাড়াবাড়ির জন্য অন্য মুসলিমরাও তাঁর নিন্দা করলেন। কুরাইশরাও এই ঘটনাকে খুব ফলাও করে প্রচার করতে লাগলো। তারা বলে বেড়াতে লাগলো, মহাম্মাদের (সা) সাহাবীরা হারাম মাসগুলিকে হালাল বানিয়ে নিয়েছে। হত্যা ও রক্ত ঝরিয়ে তারা এই মাসগুলির অবমাননা করেছে। হযরত আবদুল্লাহ ও তাঁর সাথীরা ভীষণ বিপদে পড়লেন। রাসূলুল্লাহর (সা) অবাধ্যতা হয়েছে এই ভয়ে তাঁরা ভীত হয়ে পড়লেন।

তাঁরা অনুশোচনায় জর্জরিত হতে লাগলেন। অবশেষে আল্লাহ তা’আলা তাদের কাজে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে কুরআনের এই আয়াতটি নাযিল করলেনঃ ‘হারাম (নিষিদ্ধ) মাস সম্পর্কে তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে যে, সে মাসে যুদ্ধ করা কি জায়েয? আপনি বলে দিন, এই মাসে যুদ্ধ করা বড় ধরনের অপরাধ।

আর আল্লাহর রাস্তায় বাধা দেওয়া, তাঁকে অস্বীকার করা, মসজিদে হারাম (কা’বা) থেকে বিরত রাখা এবং তার অধিবাসীদের সেখান থেকে বিতাড়িত করা আল্লাহর কাছে তার থেকেও বড় অপরাধ। আর ফিতনা বা বিপর্যয় সৃষ্টি করা হত্যা অপেক্ষাও খারাপ কাজ।’ (আল বাকারাহ- ২১৭)

কুরআনের এ আয়াত নাযিলের পর তাঁরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মুসলমানরা দলে দলে তাঁদের অভিনন্দন জানালেন এবং তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। রাসূল (সা) তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন, তাদের নিকট থেকে গনীমাতের অংশ গ্রহণ করলেন এবং মুক্তিপণ গ্রহণ করে বন্দী দু’জনকে মুক্তি দিলেন।

প্রকৃতপক্ষে আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ ও তাঁর সঙ্গীদের এ ঘটনাটি ছিল মুসলমানদের জীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাঁদের এ গনীমাত ইসলামের প্রথম গনীমাত, তাঁদের হাতে নিহত ব্যক্তি মুসলমানদের হাতে নিহত প্রথম মুশরিক বা অংশীবাদী, তাঁদের হাতে বন্দীদ্বয় মুসলমানদের হাতে প্রথম বন্দী- তাঁদেরকে দেওয়া পতাকা রাসূলুল্লাহর (সা) তুলে দেওয়া প্রথম পতাকা এবং এই দলটির আমীর আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ প্রথম আমীর যাঁকে আমীরুল মু’মিনীন বলে সম্বোধন করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবন জাহাশই প্রথম ব্যক্তি যিনি গনীমাতের ব্যাপারে সর্বপ্রথম খুমুসের প্রবর্তন করেন এবং আল্লাহ তা’য়ালা অহী নাযিল করে তা সমর্থন করেন। (আল-ইসতিয়াব)

হযরত আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ বদর ও উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। হযরত সা’দ ইবন আবি ওয়াককাস বর্ণনা করেছেন, উহুদ যুদ্ধের একদিন আগে আমি ও আবদুল্লাহ দুআ করলাম। আমার ভাষা ছিল, ‘হে আল্লাহ, আগামীকাল যে দুশমন আমাদের সাথে লড়বে সে যেন অত্যন্ত সাহসী ও রাগী হয়।

 

যাতে আমি তোমার রাস্তায় আমি তাঁকে হত্যা করে তার অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিতে পারি।’ আমার এ দুআ শুনে আবদুল্লাহ ‘আমীন’ বলে উঠে। তারপর সে হাত উঠিয়ে দুআ করেঃ হে আল্লাহ, আমাকে এমন প্রতিদ্বন্দ্বী দান কর যে হবে ভীষণ সাহসী ও দ্রুত উত্তেজিত। আমি তোমার রাস্তায় তার সাথে যুদ্ধ করবো। সে আমাকে হত্যা করে আমার নাক কান কেটে ফেলবে।

যখন আমি তোমার সাথে মিলিত হব এবং তুমি জিজ্ঞেস করবে, ‘আবদুল্লাহ, তোমার নাক-কান কিভাবে কাটা গেল?’ তখন আমি বলবো,তোমার ও তোমার রাসূলের জন্য।’ তিনি যেন দৈব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছিলেন, তাঁর এ বাসনা পূর্ণ হতে চলেছে। তাই বার বার কসম খেয়ে বলছিলেন, ‘হে আল্লাহ, আমি তোমার নামে কসম খেয়ে বলছি, আমি শত্রুর সাথে যুদ্ধ করবো এবং সে আমাকে হত্যা করে আমার নাক-কান কেটে আমাকে বিকৃত করবে।’ (উসুদুল গাবা)

হিজরী তৃতীয় সনের শাওয়াল মাসে উহুদ প্রান্তরে তুমুল লড়াই শুরু হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ এমন তীব্র আক্রমণ চালালেন যে তাঁর তরবারিটি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে খেজুর শাখার একটি ছড়ি দান করলেন। দীর্ঘক্ষণ তিনি তা দিয়ে লড়তে থাকেন।

এ অবস্থায় আবুল হাকাম ইবন আখনাস সাকাফীর একটি প্রচন্ড আঘাতে তাঁর শাহাদাতের বাসনা পূর্ণ হয়ে যায়। মুশরিকরা তাঁর দেহের বিকৃতি সাধন করে। নাক-কান কেটে সুতায় মালা গাঁথে। হযরত সা’দ এ দৃশ্য দেখে বলে ওঠেনঃ ‘আল্লাহর কসম, আবদুল্লাহর দুআ আমার দুআ অপেক্ষা উত্তম ছিল।’

চল্লিশ বছরের কিছু বেশী সময় তিনি জীবিন লাভ করেছিলেন। তাঁর মামা সাইয়্যিদুশ শুহাদা হযরত হামযার সাথে একই কবরে তাঁকে দাফন করা হয়।

 

নাখলা অভিযানে আবদুল্লাহকে আমীর নিযুক্ত করে পাঠানোর সময় রাসূল (সা) তাঁর সঙ্গীদের বলেছিলেনঃ ‘যদিও আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ তোমাদের মদ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি নয় তবে সে ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট সবচেয়ে বেশী সহ্য করতে পারে।’ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের ভালোবাসা তাঁকে দুনিয়ার সব কিছু থেকে উদাসীন করে তোলে।

প্রিয় জীবনটি আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দেওয়াই ছিল তাঁর একমাত্র বাসনা। তাঁর সে বাসনা পূর্ণ হয়েছিল। ‘আল-মুজাদ্দা’ ফিল্লাহ’ (আল্লাহর রাস্তায় কানকাটা) এ সম্মানজনক উপাধি তিনি লাভ করেছিলেন। বদর যুদ্ধে বন্দীদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা) আবু বকর, উমার ও আবদুল্লাহ ইবন জাহাশের সাথে পরামর্শ করেছিলেন।

আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনিল আস (রা:)

নাম আবদুল্লাহ, কুনিয়াত আবু মুহাম্মাদ, আবু আবদির রহমান ও আবু নুসাইর। তবে প্রথমোক্ত কুনিয়াত দু’টি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। পিতা প্রখ্যাত সেনানায়ক ও কূটনীতিবিদ হযরত ‘আমার ইবনুল’ আস (রা) ও মাতা রীতা বিনতু মুনাববিহ। বর্ণিত আছে, আবদুল্লাহর ইসলাম-পূর্ব নাম ‘আল-আস’ (পাপী, অবাধ্য)।

আবু যারয়া তাঁর তারীখে উল্লেখ করেছেন, একটি জানাযার অনুষ্ঠানে রাসূল (সা) তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমার নাম কি?’ তিনি যখন বললেন, ‘আল-আস’, আসূল (সা) তখন বললেন, না, আজ থেকে তোমার নাম হবে ‘আবদুল্লাহ’। সেই দিন থেকে ‘আল-আস’ হলেন আবদুল্লাহ।

 

ইবন সা’দ বলেন, আবদুল্লাহ তাঁর পিতা আমর ইবনুল আসের পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পুত্র আবদুল্লাহ অপেক্ষা পিতা আমরের বয়স মাত্র দশ থেকে বারো বছর বেশী ছিল। তবে ওয়াকিদীর মতে পুত্র অপেক্ষা পিতা বিশ বছরের বড় ছিলেন। (তাজকিরাতুল হুফফাল, আল-ইসাবা, আল-ইসতিয়াব) পিতা-পুত্র উভয় মক্কা বিজয়ের পূর্বেই মদীনায় হিজরাত করেন।

ইসলাম গ্রহণের পর অধিকাংশ সময় আবদুল্লাহ রাসূলুল্লাহর (সা) সহবত বা সহচর্যে ব্যয় করতেন। ক্রোধ বা শান্ত উভয় অবস্থায় রাসূলুল্লাহর (সা) মুখ থেকে যা কিছু বের হতো, তিনি সব কিছু লিখে রাখতেন। কোন কোন সাহাবী এমনটি না করার জন্য তাঁকে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, উত্তেজিত অবস্থায় রাসূলুল্লাহর (সা) মুখ থেকে যা কিছু বের হয় তা না লেখা উচিত।

বিষয়টি তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট উত্থাপন করলেন। রাসূল (সা) বললেন, ‘তুমি আমার সব কথা লিখতে পার। সত্য ছাড়া অন্য কিছুই আমি বলতে পারিনে’। (মুসনাদে আহমদ, আল-ইসতিয়াব) তাঁর পিতা আমর অপেক্ষা রাসূল (সা) তাঁকেই বেশি ভালবাসতেন এবং রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট তাঁর গুরুত্ব ছিল বেশী।

রাসূলল্লাহর (সা) সুহবত বা সাহচর্যে কাটানোর পর যে অতিরিক্ত সময়টুকু আব্দুল্লাহ পেতেন, তার সবটুকু প্রায় দিনে রোযা রেখে এবং রাতে ইবাদাতে কেটে যেত। ধীরে ধীরে এ কাজে তিনি এত গভীরভাবে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন যে, স্ত্রী-পরিজন ও দুনিয়ার সবকিছুর প্রতি নিরাসক্ত হয়ে পড়েন।

এ অবস্থায় তার পিতা রাসূলল্লাহর খিদমতে হাজির হয়ে তাঁর এই অস্বাভাবিক বৈ্রাগী জীবনে বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। রাসূল (সা) আব্দুল্লাহকে ডেকে পিতার আনুগত্যের নির্দেশ দেন।তিনি বলেন, ‘আব্দুল্লাহ, রোযা রাখ, ইফতার কর, নামায পড়, বিশ্রাম নেও এবং স্ত্রী-পরিজনে্র হকও আদায় কর। এই আমার তরীকা বা পন্থা। যে আমার তরীকা প্রত্যাখান করবে সে আমার উম্মাতের মধ্যে গণ্য হবেনা।’

রাসূলল্লাহর (সা) যুগে সংঘঠিত সব যুদ্ধে হযরত আব্দুল্লাহ অংশগ্রহন করেন। যুদ্ধের সময় সাধারণত সোয়ারী পশুর ব্যবস্থা করেন ও জিনিসপত্র পরিবহনের দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত হতো। একবার এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবু মুহাম্মদ, আমরা যেখানে বসবাস করি সেখানে দিরহাম ও দীনারের প্রচলন নেই।

গৃহপালিত পশু ও জীব-জন্তু আমাদের প্রধান সম্পদ। আমরা ছাগলের বিনিময়ে উট ক্রয়-বিক্রয় করে থকি। এতে কোন আপত্তি নেই তো? তিনি বললেন, একবার রাসূলল্লাহ (সা) নির্দেশ দিলেন একটি উষ্ট্রারোহী বাহিনী গড়ার। আমার কাছে যতগুলো উট ছিল, এক এক করে সবগুলি বিলি করলাম। তবুও সোয়ারী বিহীন কিছু লোক রয়ে গেল।

আমি রাসূলল্লাহর খিদমতে হাজির হয়ে আরজ করলাম, ‘ইয়া রাসূলল্লাহ (সা), আমার কাছে যতগুলি উট ছিল, সবগুলি বন্টন করার পরও একদল লোক রয়ে গেছে।’ রাসূল (সা) নির্দেশ দিলেন, ‘একটি উটের বিনিময়ে সদকার দু’টি, তিনটি করে উট দানের অঙ্গীকার করে কিছু উট খরীদ করে নাও।’ আমি সেই মত প্রয়োজনীয় উট সংগ্রহ করে নিলাম। (দারু কুতনী)

 

ইয়ামুকের যুদ্ধে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তিনি লড়াই করেন। এই যুদ্ধে হযরত ‘আমর ইবনুল আস তাঁর নেতৃত্বের ঝাণ্ডা আবদুল্লাহর হাতে তুলে দিয়েছিলেন।

সিফফীনে হযরত আমর ইবনুল আস ছিলেন হযরত মুয়াবিয়ার পক্ষে। পুত্র আবদুল্লাহকে তিনি মুয়াবিয়ার বাহিনীতে যোগদান করতে বাধ্য করেন। প্রকৃতপক্ষে এই গৃহযুদ্ধের প্রতি তিনি ছিলেন ভীষণ বিতৃষ্ণ। এ কারণে মুয়াবিয়ার (রা) পক্ষে যোগ দিলেও বাস্তবে তিনি যুদ্ধে কোন প্রকার অংশগ্রহণ করেননি। বারবার তিনি পিতাকে এই আত্মঘাতী যুদ্ধ থেকে দূরে সরে থাকার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। (তাজকিরাতুল হুফফাজ)

 

হযরত আম্মার বিন ইয়াসির (রা) সিফফীনে হযরত আলীর (রা) পক্ষে যোগদান করে শহীদ হন। আম্মারের শাহাদাত রাসূলুল্লাহর (সা) একটি বাণীর কথা তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি পিতা আমর ইবনুল আসকে (রা) জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি রাসূলুল্লাহকে (সা) একথা বলতে শুনেননি, আফসুস, ইবন সুমাইয়্যা (আম্মার)-কে একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী হত্যা করবে।’

একথা শুনে আমর ইবনুল আস হযরত মুয়াবিয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন, আবদুল্লাহ যা বলছে, তা-কি আপনি শুনছেন না?’ আবদুল্লাহর কথার ব্যাখ্যা করে মুয়াবিয়া (রা) বলেন, ‘সে সবসময় নতুন নতুন সমস্যা নিয়ে আসে। আম্মারকে কি আমরা হত্যা করেছি? প্রকৃতপক্ষে তাঁর হত্যার দায়-দায়িত্ব তাদের যারা তাকে ঘর থেকে বের করে এখানে সংগে নিয়ে এসেছে।’ (মুসনাদে আহমাদ)

হযরত আম্মারকে (রা) দুই ব্যক্তি একই সাথে আক্রমণ করে হত্যা করে। তারা এককভাবে এ কৃতিত্ব দাবী করে ঝগড়া করতে করতে হযরত মুয়াবিয়ার নিকট হাজির হয়। ঘটনাক্রমে সেখানে হযরত আবদুল্লাহ (রা) উপস্থিত ছিলেন। তাদের ঝগড়া শুনে তিনি বলেন, ‘তোমাদের দ’জনের কোন একজনের উচিত সন্তুষ্ট চিত্তে তার প্রতিপক্ষের দাবী মেনে নেওয়া।

কারণ, আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) বলতে শুনেছি, আম্মারকে একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী হত্যা করবে।’ অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, তিনি হযরত মুয়াবিয়াকে বলেন, আম্মারের হত্যাকারীকে জাহান্নামের সুসংবাদ দিন।’ একথা শুনে হযরত মুয়াবিয়া (রা) বিরক্তি সহকারে তাঁর পিতাকে বলেন, ‘আমর, তোমার এই পাগল ছেলেটিকে কি আমার সামনে থেকে দূরে সরিয়ে নেবে না?’ তারপর তিনি নিজেই আবদুল্লাহকে জিজ্ঞেস করেন, ‘যদি এমনই হয়, তাহলে তুমি আমার সাথে কেন?’ হযরত আবদুল্লাহ জবাব দিলেন, ‘এজন্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যতদিন বাঁচবে তোমার পিতার অনুগত থাকবে।’

 

সিফফীনের এই আত্মঘাতী যুদ্ধে যদিও তাঁর হাত কলুষিত হয়নি, তবুও এতে শরীক হওয়ার জন্য আজীবন তিনি অনুশোচনার জর্জরিত হয়েছেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘হায়, আমি যদি এর দশ বছর পূর্বেই মৃত্যুবরণ করতাম!’ হযরত মুয়াবিয়ার পক্ষ অবলম্বন করায় এবং তাঁর হাতে ঝাণ্ডা থাকায় সারা জীবন তিনি তাওবাহ ও ইসতিগফার করেছেন। (আল-ইসতিয়াব)

হযরত রাজা’ (রা) বলেনঃ একবার আমি একদল লোকের সাথে মসজিদে নববীতে বসেছিলাম। আব্দুল্লাহ ইবন আমর ও আবু সাঈদ খুদরীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। হযরত ইমাম হুসাইনকে (রা) আসতে দেখে আবদুল্লাহ বলে উঠলেন, ‘এই ব্যক্তি সম্পর্কে আমি কি আপনাদের একটি কথা জানাবো?’ লোকেরা বললো, ‘কেন জানাবে না?’ তিনি বললেন, ‘সিফফীনের যুদ্ধের পর থেকে তাঁর সাথে আমার কোন কথা হয়নি।

অথচ তাঁর সন্তুষ্টি আমার নিকট দুনিয়ার সবকিছু থেকে অধিক প্রিয়।’ আবু সাঈদ খুদরী বললেন, ‘আপনি কি তাঁর কাছে গিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চান?’ তিনি বললেন, হাঁ !’ পরদিন আবু সাঈদ খুদরী (রা) তাঁকে সংগে করে হযরত হুসাইনের (রা) বাড়ী গেলেন। হযরত হুসাইন (রা) সাক্ষাৎ দান করতে প্রথমে একটু ইতস্ততঃ করেন।

পরে আবদুল্লাহর (রা) পীড়াপীড়িতে সম্মত হন। সিফফীনে তাঁর অংশগ্রহণের পটভূমি ব্যাখা করে তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহর (সা) নির্দেশ অনুযায়ী আমি আমার তরবারি উম্মুক্ত করিনি, নিযা দ্বারা যেমন কাউকে আহত করিনি তেমনি কোন তীরও চালাইনি।’ (উসুদুল গাবা)

জ্ঞান ও মান-মর্যাদার দিক দিয়ে সমগ্র সাহাবা সমাজের মধ্যে হযরত আবদুল্লাহ (রা) বিশেষ স্থান ছিল। মাতৃভাষা আরবী ছাড়াও হিব্রু ভাষায় তাঁর পান্ডিত্য ছিল। তাওরাত ও ইনজিল তিনি গভীরভাবে অধ্যায়ন করেছিলেন। তিনি বলেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমার একহাতে মধু, অন্য হাতে চর্বি এবং আমি তা চেটে চেটে খাচ্ছি। ‘স্বপ্নের এ কথা আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) বললাম। তিনি বললেন, ‘তুমি দু’খানা গ্রন্থ তাওরাত ও আল-কুরআন পাঠ করবে’। (আল-ইসাবা)

হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) মুখ নিঃসৃত বাণীর বিরাট একটি অংশ সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি তাঁর সংগ্রহটির নাম রেখেছিলেন ‘সাদেকা’। তাঁর কাছে কোন বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে এবং সে সম্পর্কে তাঁর স্মৃতিতে কিছু না থাকলে উক্ত ‘সাদেকা’ দেখে উত্তর দিতেন। (মুসনাদে আহমদ) এই সংগ্রহটি ছিল তাঁর ভীষণ প্রিয়। মুজাহিদ বলেনঃ একবার আমি তাঁর বিছানার নীচ থেকে একখানা বই বের করে দেখতে লাগলাম।

তিনি নিষেধ করলেন। বললাম, ‘আপনি তো আমাকে কোন ব্যাপারে নিষেধ করেন না। আজ এমন করছেন কান?’ বললেন, ‘এ সত্যের সেই গ্রন্থ যা আমি একাই রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে শুনে সংগ্রহ করেছি’। তিনি আরও বলেন, ‘এই গ্রন্থখানি এবং পবিত্র কুরআন ও ওয়াহাজের ঐ জায়গীরটি যদি আমাকে দেওয়া হয় তাহলে দুনিইয়ায় আমার আর কোন কিছুর প্রয়োজন নেই।’

হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা সাত শত। তারমধ্যে সতেরটি মুত্তাফাক আলাইহি, আটটি বুখারী এবং কুড়িটি মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন। (তাহজীব)

হযরত আবদুল্লাহর (রা) হালকায়ে দারসে-হাদীসের সীমা ছিল সুপ্রশস্ত। দূর-দুরান্ত থেকে মানুষ হাদীস শোনার জন্য তাঁর দারসে হাজির হতো। তাছাড়া তিনি যেখানেই যেতেন, জ্ঞান পিপাসুদের বিশাল সমাবেশ ঘটতো তাঁর পাশে। একজন নাখয়ী শায়খ বর্ণনা করেন, ‘একবার আমি ইলিয়ার মসজিদে জামায়াতের সাথে নামায আদায় করেছিলাম। এক ব্যক্তি আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। নামায শেষে চারদিক থেকে মানুষ তাঁর নিকট গুটিয়ে বসলো। জিজ্ঞেস করে জানতে পেলাম, ইনি আবদুল্লাহ ইবন আমার ইবনুল আস।

 

হযরত আবদুল্লাহ তাঁর ছাত্রদের গভীরভাবে ভালোবাসতেন। তাঁর সমকালীন জ্ঞানীদের প্রতিও তিনি ছিলেন গভীর শ্রদ্ধাশীল। একবার তাঁর সামনে হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদের (রা) প্রসঙ্গ উঠলো। তিনি বললেন, ‘তোমরা এমন এক ব্যক্তির প্রসঙ্গ উঠিয়েছো যাঁকে আমি সেই দিন থেকে ভালোবাসি যেদিন রাসূল (সা) বলেছিলেন, তোমরা চার ব্যক্তির নিকট থেকে কুরআনের জ্ঞান অর্জন কর এবং সর্বপ্রথম তিনি আবদুল্লাহ ইবন মাসউদের নামটি উচ্চারণ করেছিলেন।’

 

হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর (রা) বহু সংখ্যক সাহাবীর নিকট থেকে, যেমনঃ উমার, আবু দারদা, মুয়াজ, আবদুর রহমান বিন আউফ, তাঁর পিতা আমর প্রমুখ- হাদীস বর্ণনা করেছেন। আবু নুয়াঈম বলেন, ‘সাহাবীদের মধ্যে ইবন উমার, আবু উমামা, মিসওয়ার, সায়িব ইবন ইয়াযিদ ও আবুত তুফাইল এবং বহু সংখ্যক বিশিষ্ট তাবেঈ তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। (আল-ইসাবা)

তাকওয়া, পরহিযগারী ও অতিরিক্ত ইবাদাতকারী হিসাবে আবদুল্লাহ ইবন আমরের বিশেষ প্রসিদ্ধি ছিল। ইতিহাসে তাঁকে প্রার্থনাকারী, তাওবাকারী, ইবাদাত গুজার, ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। তাঁর পিতা আমর ছিলেন যেমন বুদ্ধিমত্তা, চাতুর্য ও কৌশলীদের গুরু, তেমনি তিনি ছিলেন আবেদ, যাহেদ ও স্পষ্টবাদীদের মধ্যমণি। তাঁর জীবনের সবটুকু ইবাদাতে ব্যয় হয়েছে। যখন যতটুকু কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, মুখস্থ করে ফেলেছেন।

কুরআনের অবতরণ শেষ হলে তিনিও হলেন সমগ্র কুরআনের হাফেজ। জিহাদের ময়দানে সব সময় তাঁকে প্রথম সারিতে দেখা যেত। আবার সশস্ত্র জিহাদ শেষ হলে তাঁকে দেখা যেত মসজিদে-দিনে রোযাদার এবং রাতে ইবাদাত গুজার। কুরআন ও তাসবীহ তিলাওয়াত অথবা তাওবাহ ইসতিগফারে তিনি নিমগ্ন থাকতেন। মোটকথা, যখন জিহাদের ডাক না থাকতো, চব্বিশ ঘন্টা তিনি সাওম, সালাত ও তিলাওয়াতে ডুবে থাকতেন।

 

প্রকৃতিগতভাবেই রুহবানিয়্যাত বা বৈরাগ্যের প্রতি তাঁর ঝোঁক প্রবণতা ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) একবার তাঁকে ডেকে বললেন, ‘আবদুল্লাহ, আমি জানতে পেরেছি, তুমি সারাটি জীবন দিয়ে রোযা রেখে ও রাতে ইবাদাত করে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য সংকল্প করেছো’। তিনি বললেন, ‘হাঁ, ইয়া রাসূলুল্লাহ।’ রাসূল (সা) বললেন, ‘সে শক্তি তোমার নেই। রোযা রাখ, আবার ইফতারও কর এবং নামায পড়, আবার বিশ্রামও কর। মাসে শুধু তিন দিন রোযা রাখ। কারণ, প্রতিটি নেকীর দশগুণ বদলা দেওয়া হয়।’

তিনি আরজ করলেন, ‘আমি এর থেকেও বেশী শক্তি রাখি’। রাসূল (সা) বলেলেন, ‘একদিন রোয রাখবে এবং দইদিন ইফতার করবে’। তিনি আবার আরজ করলেন, ‘আমি এর থেকেও বেশী শক্তি রাখি। ‘রাসূল (সা) বললেন’, একদিন রোযা রাখবে এবং একদিন ইফতার করবে। এটাই হযরত দাউদের (আ) তরীকা এবং এটাই রোযার সর্বোত্তম তরীকা বা পদ্ধতি’। তিনি আবারও আরজ করলেন।

‘আমি এর থেকেও উত্তম রোযা রাখতে পারি’। রাসূল (সা) বললেন, ‘এর থেকে উত্তম রোযা আর নাই’। অন্য একবার রাসূল (সা) তাঁর বাড়ীতে যেয়ে বলেন, ‘তোমার দেহের, তোমার চোখের, তোমার পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবের তোমার ওপর হক বা অধিকার আছে’।

সারাটি জীবন তিনি রোযার ক্ষেত্রে দাউদের (আ) অনুসরণ করেন এবং রাতের বেশীর ভাগ সময় ইবাদাতে অতিবাহিত করেন। কুরআন তিলাওয়াতের এত বেশী আগ্রহ ছিল যে, প্রতি তিন দিনে একবার খতম করতেন। তবে শেষ জীবনে এত অধিক ইবাদাত তাঁর জন্য কষ্টদায়ক হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে আফসুস করে বলতেন, ‘হায়, যদি আমি রাসূলুল্লাহ (সা) প্রদত্ত ‘রুখসত’ বা কম করার অনুমতি গ্রহণ করতাম। (আল-ইসাবা)

 

দুনিয়ার প্রতি আবদুল্লাহর এই উদাসীনতা দেখে তাঁর পিতা ’আমর ইবনুল ’আস প্রায়ই রাসূলুল্লাহর কাছে অভিযোগ করতেন। একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) আবদুল্লাহর দাতটি ধরে তাঁর পিতার হাতের মধ্যে দিয়ে বলেন, ‘তোমাকে আমি যা বলি তাই কর, এবং তোমার পিতার ইতায়াত বা আনুগত্য কর’। [রিজালুন হাওলার রাসূল (সা)] আবদুল্লাহ আজীবন তাঁর পিতার আনুগত্য করেছেন। পিতার নির্দেশেই তাই তিনি মুয়াবিয়ার পক্ষে সিফফীনে গিয়েছেন।

 

হযরত ’আমর ইবনুল ’আস (রা) পৈত্রিক মীরাস থেকে বিশাল সম্পত্তি ও বহু দাস-দাসী লাভ করেন। তায়েফ ‘ওয়াহাজ’ নামক যে জায়গীরটি তিনি লাভ করেন তার মুল্য ছিল প্রায় দশ লাখ দিরহাম। (উসুদুল গাবা) তাঁর পক্ষ থেকে সেখানে চাষাবাদ করা হতো। এই জায়গীর নিয়ে একবার আম্বাসা ইবন সুফইয়ানের সাথে বিবাদ দেখা দেয়। উভয় পক্ষে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যাওয়ার উপক্রম হয়। আবদুলাহর ভাই হযরত খালিদ ইবনুল ’আস আসলেন তাঁকে বুঝানোর জন্য। তিনি খালিদকে বললেন, ‘যে ব্যক্তি তার সম্পদের হিফাজত বা রক্ষণবেক্ষোণ করতে যেয়ে নিহত হবে সে শহীদ-তোমার কি রাসূলুল্লাহর (সা) এ বাণী স্মরণ নেই?’ (মুসনাদে আহমদ)

 

হযরত আবদুল্লাহর (রা) মৃত্যুর সন ও স্থান সম্পর্কে সীরাত লেখকদের মতভেদ রয়েছে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স কত হয়েছিল সে সম্পর্কেও ঐতিহাসিকরা একমত হতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর স্থান সম্পর্কে যেমন শাম, মক্কা, তায়েফ ও মিসরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তেমনি সন হিসাবে ৬৫, ৬৮ ও ৬৯ হিজরীর কথা বলা হয়েছে। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতে তিনি হিজরী ৬৫ সনে ‘ফুসতাত’ (মিসর) নগরে ৭২ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। তখন মারওয়ান ইবনুল হাকাম ও আবদুল্লাহ ইবন যুবাইরের বাহিনীর মধ্যে তুমুল লড়াই চলছিল, এ কারণে তাঁর লাশ সাধারণ গোরস্তানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তাঁকে তাঁর আবাস স্থলেই দাফন করা হয়। (আল-ইসাবা, তাজকিরাতুল হুফফাজ)

মিকদাদ ইবন ’আমর (রা:)

নাম মিকদাদ, কুনিয়াত আবুল আসওয়াদ, আবু ’আমর ও আবু সাঈদ। পিতা ’আমর ইবন সা’লাবা। তাঁর পিতৃ পুরুষের আদি বাসস্থান ‘বাহারা’। ইবনুল কালবী বর্ণনা করেন, মিকদাদের পিতা ’আমর তাঁর গোত্রের এক ব্যক্তিকে হত্যা করে ‘কিসাস’ বা প্রতিশোধের ভয়ে ‘হাদরামাউতেই’ পালিয়ে যান এবং কিন্দার সাথে মৈত্রী চুক্তি করেন।

এ কারণে তাঁকে ‘কিন্দী’ বলা হয়। তিনি হাদরামাউতের এক নারীকে বিয়ে করেন এবং তার গর্ভেই ‘মিকদাদ’ জম্মগ্রহণ করেন। এই হাদরামাউতেই মিকদাদ বেড়ে ওঠেন। এখানে আবু শাম্মার ইবন হাজার আল কিন্দী নামক এক ব্যক্তির সাথে তাঁর ঝগড়া হয় এবং তরবারির এক আঘাতে তার একটি পা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। অতঃপর পালিয়ে মক্কায় চলে যান। মক্কায় তিনি আল-আসওয়াদ ইবন ’আবদ ইয়াগূসের সাথে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে থাকেন।

আল-আসওয়াদের সাথে তাঁর সম্পর্ক এত মধুর ও ঘনিষ্ঠ হয় যে, মিকদাদকে তিনি পালিত পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেন। এভাবে তিনি মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ (আসওয়াদের পুত্র মিকদাদ) নামে পরিচিতি লাভ করেন। অতঃপর পবিত্র কুরআনের ‘ওয়াদয়ূহুম লি আবায়িহিম’ (তাদেরকে তাদের পিতার নামেই ডাক)-এ আয়াতটি নাযিল হলে তিনি আল-আসওয়াদের পরিবর্তে ‘মিকদাদ ইবন আমর’ (আমরের পুত্র মিকদাদ)-এ পরিচিতি গ্রহণ করেন। আর এ কারণে ইতিহাসে কোথাও তাঁকে মিকদাদ ইবন আমর আবার কোথাও মিকদাদ ইবনুল আসওয়াদ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (আল-ইসাবা, উসুদুল গাবা)।

 

মিকদাদ মক্কায় আশ্রয় নেয়ার পর কিছুদিন যেতে না যেতে তাওহীদের আওয়ায তাঁর কানে প্রবেশ করে। হযরত রাসূলে করীমের দাওয়াত ও তাবলীগ তাঁকে ইসলামের সাথে প্রথম পরিচয় করে দেয়। এ সেই সময়ের কথা যখন ইসলামের কট্টর দুশমনরা মুসলমানদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছিল। তাদের ভয়ে অনেকেই তখন ইসলাম গ্রহণের কথা গোপন রেখেছিল। কিন্তু মিকদাদ ইসলাম গ্রহণ করার পর সত্যকে গোপন করে রাখা সমীচীন মনে করলেন না।

তিনি প্রথম পর্যায়ের সাত ব্যক্তির অন্যতম, যারা সেই চরম সন্ত্রাসের মুহূর্তে প্রকাশ্যে নিজেদের ঈমান আনার কথা ঘোষণা করেছিলেন। এই সাত জনের অন্য ছয়জন হলেন রাসূলুল্লাহ (সা), আবু বকর, ’আম্মার, তাঁর মা সুমাইয়্যা, সুহাইব ও বিলাল (রা)। (হায়াতুস সাহাবা-১/২১৮)।

রাসূলুল্লাহর (সা) চাচাতো বোন ‘দুবায়া বিনতু যুবাইর ইবন আবদিল মুত্তালিবের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। বর্ণিত আছে, একদিন আবদুর রহমান ইবন আউফের সাথে তিনি বসে আছেন। হঠাৎ আবদুর রহমান জিজ্ঞেস করেন, মিকদাদ তুমি বিয়ে করছো না কেন? মিকদাদ সরলভাবে সাথে সাথে জবাব দেন, তোমার মেয়েকেই আমার সাথে বিয়ে দাও না।

এ কথায় আবদুর রহমান অপমান বোধ করেন। তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেন এবং মিকদাদকে যথেষ্ট গালমন্দ করেন। মিকদাদ রাসূলুল্লাহর (সা) কাছে এসে আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন। রাসূল (সা) বললেন, আমিই তোমার বিয়ে দেব। অতঃপর তিনি চাচাত বোন ‘দুবায়া’-র সাথে মিকদাদের বিয়ে দেন। (আল-ইসাবা)

 

প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দেয়ার পর মিকদাদের ওপর মুসীবত নেমে আসে। রাসূলুল্লাহর (সা) অনুমতি নিয়ে তিনি হাবশায় হিজরাত করেন। সেখানে কিছুকাল অবস্থানের পর আবার মক্কায় ফিরে আসেন। তখন মদীনায় হিজরাতের হিড়িক পড়ে গেছে। বিশেষ কিছু অসুবিধার কারণে তিনি মদীনায় হিজরাত করতে পারলেন না।

এমন কি রাসূলুল্লাহর মদীনায় হিজরাতের পরও তিনি মক্কায় থেকে গেলেন। মক্কা ও মদীনার মধ্যে সাময়িক সংঘর্ষ হলে তিনি এবং উতবা ইবন গাযওয়ান কুরাইশদের একটি অগ্রবর্তী অনুসন্ধানী দলের সদস্য হিসাবে মদীনার দিকে রওয়ানা হন। এই বাহিনীর নেতা ছিলেন ইকরিমা ইবন আবী-জাহল। পথিমধ্যে মদীনার মুজাহিদদের একটি দলের সাথে তাদের ছোট খাট একটা সংঘর্ষ হয়। এই মুসলিম মুজাহিদ দলের নেতা বা আমীর ছিলেন হযরত উবাইদা ইবনুল হারিস (রা)।

সুযোগ বুঝে এ সময় মিকদাদ ও উতবা ইবন গাযওয়ান মুসলিম মুজাহিদ দলে ভিড়ে যান এবং তাদের সাথে মদীনায় পৌঁছেন। মদীনায় তাঁরা হযরত কুলসুম ইবন হিদামের অতিথি হন। (উসুদুল গাবা) মদীনায় তিনি হযরত উবাই ইবন কা’বের (রা) অনুরোধে বনী আদীলা (মতান্তরে জাদীলা)-তে বসবাসের ইচ্ছা প্রকাশ করলে রাসূল (সা) তাঁকে সেই এলাকায় একখণ্ড জমি দান করেন।

হিজরী দ্বিতীয় সনে শিরক ও তাওহীদের মধ্যে প্রথম প্রত্যক্ষ সামরিক সংঘর্ষ শুরু হয়। এ বছরই কুরাইশ বাহিনী বদর প্রান্তরে উপনীত হয়। রাসূলুল্লাহর (সা) সাহাবীদের জন্য এ ছিল প্রথম পরিক্ষা। রাসূল (সা) এ ব্যাপারে তাঁদের পরামর্শ চেয়ে তাঁদের ঈমানের পরীক্ষা নিতে চাইলেন। হযরত সিদ্দীকে আকবর ও ফারুকে ’আজম প্রমুখ সাহাবা ভাষণ দিয়ে তাঁদের কুরবানী ও আত্মত্যাগের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

হযরত মিকদাদও এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি এক আবেগময় ভাষণ দান করেন। ভাষণে তিনি রাসূলকে (সা) আশ্বাস দান করে বলেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহ আপনাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন তা বাস্তবায়নে এগিয়ে চলুন। আপনার সাথে আছি। আল্লাহর কসম, বনী-ইসরাইলরা তাদের নবী মুসাকে বিলেছিলঃ তুমি ও তোমার রব দু’জন যাও এবং যুদ্ধ কর, আর আমরা এখানে বসে থাকি – আমরা আপনাকে তেমন কথা বলবো না।

বরং আমরা আপনাকে বলবোঃ আপনি ও আপনার রব দু’জন যান ও তাদের সাথে যুদ্ধ করুন আমরাও আপনাদের সাথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো। যিনি সত্যসহ আপনাকে পাঠিয়েছেন সেই সত্তার কসম, আপনি যদি আমাদের ‘বারকুল গিমাদ’ পর্যন্ত নিয়ে যান, আমরা আপনার সাথে যাব এবং আপনার শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো।

আমরা আপনার ডানে, বামে, সামনে ও পেছনে সর্বদিক থেকে যুদ্ধ করবো –যতক্ষণ না আল্লাহ আপনাকে বিজয় দান করেন।” (রিজালুন হাওলার রাসূল) তাঁর এই আবেগময় ভাষণ শুনে খুশীতে রাসূলুল্লহর (সা) চেহারা মুবারক উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

বদর যুদ্ধ শুরু হলো। এ যুদ্ধে মুসলিম মুজাহিদদের মধ্যে মাত্র তিনজন ছিলেন অশ্বরোহী। মিকদাদ ইবন আমর, মুরছেদ ইবন আবী মুরছেদ ও যুবাইর ইবনুল আওয়াম। এ তিনজন ছাড়া অন্য সকলেই ছিলেন পদাতিক ও উষ্ট্ররোহী। তবে একাধিক বর্ণনা মতে এ যুদ্ধে মিকদাদই ছিলেন একমাত্র অশ্বরোহী মুজাহিদ। এ কারণে বলা হয়েছে, ‘মিকদাদই সর্বপ্রথম আল্লাহর রাস্তায় তাঁর ঘোড় দৌড়িয়াছেন।’

বদর ছাড়াও উহুদ, খন্দকসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করে বীরত্বর পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। হিজরী ২০ সনে হযরত আমর ইবনুল আস মিসর অভিযান পরিচালনা করেন। রাজধানী মদীনায় তিনি অতিরিক্ত সামরিক সাহায্য চেয়ে পাঠান। খলীফা উমার (রা) দশ হাজার সিপাহী ও চারজন অফিসার পাঠান।

এই চারজনের একজন মিকদাদ ইবন আমর। খলীফা একটি চিঠিতে আমর ইবনুল আসকে লিখে জানান, ‘এই চার জনের প্রত্যেকেই শত্রু পক্ষের দশ হাজার সিপাহীর সমান’। এই সিপাহীদের যোগদানের পর অতি অল্প সময়ের মধ্যে সমগ্র মিসরে ইসলামের পতাকা উডডীন হয়।

হযরত খুবাইবকে (রা) মক্কার মুশরিকরা শূলে চড়িয়ে হত্যা করে। রাসূলুল্লাহ (সা) খুবাইবের লাশ রাতের আঁধারে শূল থেকে নামিয়ে আনার জন্য যুবাইর ও মিকদাদকে পাঠান। তাঁরা খুবাইবের লাশ শূল থেকে নামিয়ে ঘোড়ার পিঠে উঠিয়ে যখন রওয়ানা দেন তখন কুরাইশরা টের পেয়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে। (হায়াতুস সাহাবা)

 

হযরত মিকদাদের পেটটি ছিল খুবই মোটা। এ কারণে বার্ধক্যে তিনি ভীষণ কষ্ট পেতে থাকেন। এ কষ্ট লাঘব করার উদ্দেশ্যে তাঁর এক রোমান দাস তার পেটে অস্ত্রোপচার করে; কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। এ অবস্থায় তিনি মদীনা থেকে তিন মাইল দূরে ‘জুরুফ’ নামক স্থানে হিজরী ৩৩ সনে ইহলোক ত্যাগ করেন। আমীরুল মুমিনীন হযরতব উসমান (রা) তাঁর জানাযার নামায পড়ান। লাশ মদীনার বাকী গোরস্থানে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৭০ বছর।

 

হযরত মিকদাদের মধ্যে সর্বোত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটেছিল। বদর যুদ্ধের সময় তিনি যে নিষ্ঠা ও সততাপূর্ণ আবেগ প্রকাশ করেন তাতে সমগ্র সাহাবা সমাজ তাঁকে ঈর্ষা করতে থাকে। হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা) বলতেনঃ ‘আফসূস! আমি যদি তখন বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণের উপযুক্ত হতাম এবং মিকদাদের কথাগুলি আমার মুখ থেকে বের হতো’। হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ বলেন, ‘বদর যুদ্ধে আমি মিকদাদের সাথে ছিলাম।

এ যুদ্ধে তাঁর সাথে থাকার বিষয়টি আমার কাছে এত প্রিয় যে, তার তুলনায় দুনিয়ার সব কিছু একেবারেই মূল্যহীন’। ইসলামের সূচনালগ্নের চরম দারিদ্র ও অভাব তাঁকে অনেকখানি সহনশীল ও বাস্তববাদী করে তুলেছিল। তিনি বলেন, “হিজরাত করে আমি যখন মদীনায় আসলাম, আমার থাকা-খাওয়ার কোন ঠিক-ঠিকানা ছিল না।

ক্ষুধায় আমার মরণ-দশা হয়েছিল। অবশেষে রাসূলুল্লাহ (সা) আমার দু’জন সংগীসহ আমাকে তাঁর আশ্রয়দাতা কুলসুম ইবন হিদামের বাড়ীতে স্থান দেন। তখন রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট মাত্র চারটি ছাগী। আমরা এতগুলি মানুষ এই ছাগীগুলির দুধপান করেই জীবন ধারণ করতাম। একদিন রাতে রাসূলুল্লাহ (সা) বাইরে কোথাও বেরিয়ে গেলেন। ফিরতে দেরী হল। আমি মনে করলাম, হয়তো কোন আনসারী তাঁকে দাওয়াত দিয়েছেন, তিনি খেয়েই ফিরবেন।

এই ধারণা আমার মনে উদয় হতেই আমি উঠে পড়লাম এবং রাসূলুল্লাহর (সা) জন্য রাখা দুধটুকু এক চুমুকে পান করে ফেললাম। কিন্তু পরক্ষণেই চেতনা হলো, আমার ধারণা যদি ভুল হয় তাহলে তো ভীষণ লজ্জায় পড়তে হবে। আমার এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে রাসূল (সা) ফিরে আসলেন এবং সোজা দুধ যেখানে থাকে সেদিকে এগিয়ে গেলেন। দেখলেন, পেয়ালা শুন্য। আমি আমার ভুলের জন্য লজ্জা ও অনুশোচনায় জর্জরিত হতে লাগলাম।

বিশেষ করে তিনি যখন কিছু বলার জন্য হাত উঠালেন তখন আমার ভয়ের কোন সীমা থাকলো না। আমার ধারণা হল, রাসূলুল্লাহর (সা) বদ দুআয় এখনই আমার ইহ-পরকাল সব বরবাদ হয়ে যাবে। কিন্তু তাঁকে আমি বলতে শুনলাম, ‘আল্লাহুম্মা আতয়িমহু মান আতয়ামানী ওয়া আসকি মান সাকানী’- হে আল্লাহ, যে আমাকে আহার করালো তাকে তুমি আহার করাও, যে আমাকে পান করালো তাঁকে তুমি পান করাও।

এই দুআ শুনে আমার মধ্যে সাহস সঞ্চার হলো। আমি উঠে ছাগীগুলির কাছে গেলাম, কোন ছাগীর ওলানে কিছু দুধ পাওয়া যায় কিনা এই আশায়। কিন্তু আল্লাহর সীমাহীন কুদরতে যে ছাগীর উলানেই হাত দিই না কেন প্রত্যেকটি দুধে পরিপূর্ণ পেলাম। প্রচুর পরিমাণে দুধ দুইয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) সামনে পেশ করলাম।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা সবাই পান করেছ কি? আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি প্রথমে পান করুন, তারপর সমস্ত ঘটনা খুলে বলছি। রাসূল (সা) পেট ভরে পান করলেন। আমার পূর্বের ভুল ও অনুশোচনার কথা মনে হওয়ায় হঠাৎ হেসে উঠলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবুল আসওয়াদ, হাসছো কেন?’ আমি সব কথা খুলে বললাম। সব কিছু শুনে তিনি বললেন, “এ ছিল আল্লাহর রহমত। তুমি তোমার সাথী দু’জনকে ঘুম থেকে জাগালে না কেন, তারাও অনুগৃহীত হতো?”

হযরত মিকদাদ ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান। তাঁর বুচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায় বহু ক্ষেত্রে ও ঘটনায়। তাঁর এক সাথী বর্ণনা করেছেন, একদিন আমরা মিকদাদের কাছে বসে ছিলাম। এমন সময় একজন তাবেয়ী তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন, রাসূলুল্লাহর (সা) দর্শন লাভে ধন্য আপনার চোখ দু’টি কতই না সৌভাগ্যের অধিকারী।

আল্লাহর কসম, আপনি যা কিছু দেখেছেন, তা দেখার এবং যেসব দৃশ্য ও ঘটনায় আপনি উপস্থিত হয়েছেন তাতে উপস্থিত হওয়ার জন্য আমি খুবই লালায়িত। একথা শুনে মিকদাদ লোকটির উপর খুবই ক্ষেপে গেলেন। লোকেরা বললো, তা এত উত্তেজিত হওয়ার কি আছে? তিনি বললেন, বর্তমানকে ছেড়ে অতীতকে কামনা করা বৃথা কাজ।

কারণ, একথা তার জানা নেই, তখন সে থাকলে তার ভূমিকা কী হতো। আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহর (সা) সমসাময়িক বহুলোক ঈমান না আনার কারণে তাদের ঠিকানা হয়েছে জাহান্নাম। সে কি জানে সে কোন দল্ভুক্ত হতো? এমন বিপদ থেকে আল্লাহ যে তাকে রক্ষা করেছেন এবং তিনি তাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা) প্রতি ঈমানদার বানিয়েছেন এজন্য কি সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে না?

রাসূলুল্লাহ (সা) একদিন তাঁকে একটি দলের আমীর নিযুক্ত করেন। তিনি ফিরে আসলে রাসূল (সা) জিজ্ঞেস করেন, ‘ইমারাত বা নেতৃত্ব কেমন লাগলো?’ জবাবে তিনি বড় একটি সত্য কথা বলে ফেলেন।

বলেন, ‘নিজেকে আমার সবার ওপরে এবং অন্যদের আমার নীচে মনে হয়েছে। যিনি সত্যসহ আপনাকে পাঠিয়েছেন,তাঁর শপথ, আজকের পর আর কক্ষণো আমি দু’ব্যক্তির ওপর আমীর হবো না’। তিনি নিজের দুর্বলতা ঢাকার বা সত্য গোপন করার চেষ্টা করেননি। তিনি সব সময় রাসূলুল্লাহর এ হাদীসটি আওড়াতেনঃ ‘ফিতনা থেকে যে ব্যক্তি পরিত্রাণ পেয়েছে, সে প্রকৃত সৌভাগ্যবান।’

রাসূলুল্লাহকে (সা) তিনি নিজের প্রাণের চেয়ে ভেশী ভালোবাসতেন। তাঁর মধ্যে ছিল আল্লাহর রাসূলের (সা) হিফাজত বা নিরাপত্তার চরম দায়িত্বানুভূতি। মদীনায় কোন প্রকার হৈ চৈ দেখা গেলেই রাসূলুল্লাহর (সা) বাসগৃহের দরজায় তাঁকে সশস্ত্র ও অশ্বরোহী অবস্থায় দেখা যেত। ইসলামের বিধি-বিধান যথাযথ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর।

ইসলামের প্রকাশ্য দুশমনদের বিরুদ্ধে যেমন ছিলেন সজাগ, তেমনি ছিলেন নিজের বন্ধুদের ইসলাম সম্পর্কে সামান্য উদাসীনতা ও ভুল-ত্রুটির ব্যাপারে দারুণ সচেতন। একবার তিনি একটি ক্ষুদ্র বাহিনীর সাথে অভিযানে বের হলেন। শত্রু বাহিনী তাদের ঘিরে ফেলে। বাহিনীর আমীর নির্দেশ দিলেন, বাহিনীর কোন সহস্যই আজ তাঁর সোয়ারী- পশু চড়ানোর জন্য ছাড়বে না। কিন্তু একজন মুজাহিদ বিষয়টি অবহিত ছিলেন না।

তিনি আমীরের আদেশের বিপরীত কাজ করেন। এ জন্য তিনি আমীরের নিকট থেকে তাঁর প্রাপ্য শাস্তি থেকেও অধিক শাস্তি লাভ করেন। মুজাহিদটি কাঁদছিল, এমন সময় মিকদাদ তাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করে বিষয়টি অবগত হলেন। অতঃপর তাঁর ডান হাতটি ধরে তাঁকে আমীরের কাছে টেনে নিয়ে গেলেন এবং আমীরের সাথে তর্ক করে তাঁর ভুল স্বীকার করতে বাধ্য করেন।

আমীরকে তিনি বলেন, লোকটিকে কিসাস গ্রহণের সুযোগ দিয়ে নিজেকে দায়মুক্ত করুন। মিকদাদের কথা আমীর মাথা পেতে নিলেন। অবশ্য লোকটি আমীরকে ক্ষমা করে দেন। এভাবে তিনি দ্বীনের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় সর্বদা অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করতেন। তিনি প্রায় সব সময় বলতেন, ‘আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন তোমাকে ভালোবাসতে এবং আমাকে এ খবরও দিয়েছেন যে, তিনি তোমাকে ভালোবাসেন।’ এভাবে তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসা লাভে ধন্য হয়েছেন।

 

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘প্রত্যেক নবীকে সাতজন বিশ্বস্ত সাথী ও উযীর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাকে দেওয়া হয়েছে চৌদ্দ জন। তারা হলেনঃ হামযা, জাফর, আবু বকর, উমার, আলী, হাসান, হুসাইন, আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ, সালমান, আম্মার, হুজাইফা, আবু জাফর, মিকদাদ ও বিলাল।

তোষামোদ বা প্রসংশা তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। একবার হযরত উসমানের (রা) দরবারে কিছু লোক মিকদাদের সামনেই তাঁর প্রশংসা শুরু করে দিল। তিনি এতে রুষ্ট হলেন যে, তাদের মুখে মাটি ছুঁড়ে মারলেন। হযরত উসমান (রা) বলে উঠলেন, মিকদাদ, এ কী হচ্ছে? বললেন, রাসূলুল্লাহ আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, ‘তোমরা প্রশংসাকারীর মুখে মাটি ছুঁড়ে মার।’

 

ব্যবসা ছিল তাঁর আসল পেশা। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁকে খাইবার অঞ্চলে কিছু ভূমি দান করেন। পরবর্তীকালে মিকদাদের ওয়ারিসদের নিকট থেকে এক লাখ দিরহামের বিনিময়ে হযরত মুয়াবিয়া (রা) তা খরীদ করে নেন।

হযরত মিকদাদের স্ত্রী দুবায়া বর্ণনা করেন, একবার মিকদাদ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য বাকী’র একটি নির্জন স্থানে যান। তিনি কর্ম সমাধা করছেন, এমন সময় দেখতে পেলেন একটি ইঁদুর তার গর্ত থেকে একটি দিনার বের করে আনছে। এভাবে ইঁদুরটি মোট সতেরটি দীনার বের করে আনে।

তিনি সেগুলি কুড়িয়ে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট নিয়ে এসে ঘটনা খুলে বলেন। তিন গর্তে হাত দুকিয়েছেন কিনা রাসূল (সা) তা জানতে চান। তিনি যখন বললেন, না, তিনি হাত ঢুকাননি, তখন রাসূল (সা) বললেন, আল্লাহ তোমার এ সম্পদে বরকত দিন। তোমার এ সম্পদের উপর কোন যাকাত নেই। (হায়াতুস সাহাবা-৩/৬৪৫)

হযরত মিকদাদ (রা) রাসূলুল্লাহর (সা) থেকে বেশ কিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং আলী, আনাস, উদাইদুল্লাহ ইবন আদী, হাম্মাম ইবনুল হারস, আবদুর রহমান ইবন আবী লাইলা প্রমুখ সাহাবী তাঁর নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

মুগীরা ইবন শু’বা (রা:)

নাম আবু আবদিল্লাহ মুগীরা, পিতা শু’বা ইবন আবী আমের। আবু আবদিল্লাহ ছাড়াও আবু মুহাম্মাদ ও আবু ঈসা তাঁর কুনিয়াত। বনী সাকীফ গোত্রের সন্তান। তাঁর মা উমামা বিনতু আফকাম বনী নাসের ইবন মুয়াবিয়া গোত্রের কন্যা। হিজরী পঞ্চম সনে খন্দক যুদ্ধের বছর ইসলাম গ্রহণ করেন এবং ঐ বছরই মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করে রাসূলুল্লাহর (সা) সাহচর্যে অবস্থান করতে থাকেন। (আল-ইসাবা-৩/৪৫২, উসূদুল গাবা-৪/৪০৬, আল-ইসতিয়াব) হযরত রাসূলে কারীমের (সা) সাথে মুগীরার সর্বপ্রথম কখন পরিচয় হয় সে সম্পর্কে একটি ঘটনা বায়হাকী বর্ণনা করেছেন।

মুগীরা বলেনঃ আমি প্রথম যেদিন রাসূলুল্লাহর সাথে পরিচিত হই, সেদিন আবু জাহল ও আমি মক্কার এক ছোট্ট গলিপথ দিয়ে হাঁটছিলাম। এমন সময় রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হল। রাসূল (সা) আবু জাহলকে বললেনঃ ইয়া আবাল হাকাম – ওহে আবুল হাকাম; আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে এস।

আবু জাহল বললোঃ ইয়া মুহাম্মাদ! তুমি কি আমাদের ইলাহ বা মা’বুদদের নিন্দামন্দ থেকে বিরত হবে না? তুমি কি শুধু চাও আমরা সাক্ষ্য দিই যে, তুমি পৌঁছিয়েছ? তাহলে আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, তুমি পৌঁছে দিয়েছে। আল্লাহর কসম, আমি যদি জানতাম তুমি যা বলছো তা সত্য, তাহলে আমরা তোমার ইত্তেবা বা অনুসরণ করতাম। রাসূলুল্লাহ (সা) চলে গেলেন।

আবু জাহল আমাকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলোঃ আল্লাহর কসম! আমি নিশ্চিতভাবে জানি, মুহাম্মাদ যা বলে তা সত্য। কিন্তু আমাকে তা গ্রহণ করতে যে জিনিস বাধা দেয় তা হচ্ছেঃ বনু কুসাই দাবী করলো, হিজাবাহ আমাদের। (অর্থাৎ কা’বার চাবি তাদের কাছে থাকে, তাদের অনুমতি ব্যতীত কেউ কা’বার অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে না) আমরা বললামঃ হাঁ।

তারা বললোঃ সিকায়াহ আমাদের। (হাজীদের পানি পান করানোর দায়িত্ব) আমরা বললামঃ হাঁ। তারা বললোঃ ‘আন-নাদওয়াহ আমাদের।’ (পরামর্শ সভার দায়িত্ব) আমরা বললামঃ হাঁ। তারপর তারা বললোঃ’আল-লিওয়া’ (যুদ্ধের পতাকা) আমাদের।’ আমরা বললামঃ হাঁ। তারা মানুষকে আহার করায়, আমরাও আহার করলাম। এই ব্যাপারে আমরা যখন তাদের সমকক্ষতা অর্জন করলাম, তখন তারা বললোঃ আমাদের নবী আছে।

আল্লাহর কসম, আমি তা মানতে পারিনে। (হায়াতুস সাহাবা ১/৮৪) তিনি হুদাইবিয়া অভিযানে রাসূলুল্লাহর (সা) সফরসঙ্গী হয়ে বাইয়াতে রিদওয়ানে শরিক হন। কুরাইশরা মক্কায় প্রবেশে বাধার সৃষ্টি করে। কুরাইশ পক্ষে উরওয়া ইবন মাসউদ আস-সাকাফী রাসূলুল্লাহর (সা) সাথে আলোচনার জন্য আসে। আরবের সাধারণ প্রথা অনুযায়ী সে কথা বলার মধ্যে মাঝে মাঝে রাসূলুল্লাহর (সা) প্রবিত্র দাড়ির দিকে হাত বাড়াতে থাকে।

মুসলমানদের নিকট এটা ছিল অমার্জিত আচরণে তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়ছিলেন। যখনই উরওয়া হাত সম্প্রসারণ করছিল, মুগীরার হাত অবলীলাক্রমে তার তরবারির বাঁটের ওপর চলে যাচ্ছিল। এক সময় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। তিনি ধমকের সুরে বললেনঃ সাবধান! হাত নিয়ন্ত্রণে রাখ। উরওয়া ঘাড় ফিরে তাকালো।

তাঁকে চিনতে পেরে বললোঃ ‘ওরে ধোঁকাবাজ! আমি কি তোর পক্ষে কাজ করিনি? উল্লেখ্য যে, উরওয়া ছিল মুগীরার চাচা। জাহিলী যুগে মুগীরা কয়েকজন লোককে হত্যা করে। এই উরওয়া ইবন মাসউদ নিহত লোকদের দিয়াত বা রক্তমূল্য আদায় করে। উরওয়া এই ঘটনার প্রতিই ইঙ্গিত করেছিল। (বুখারীঃ কিতাবুশ শুরুতে ফিল জিহাদ ওয়াল মুসালিহা, উসুদুল গাবা-৪/৪০৬ হায়াতুস সাহাবা-১/১০২) হুদাইবিয়ার পর তিনি একাধিক অভিযানে অংশগ্রহণের গৌরব অর্জন করেন।

রাসূলুল্লাহ (সা) একটি বিশেষ বাহিনীর সাথে তাঁকে ও আবু সুফইয়ানকে তায়েফে পাঠান। তাঁরা বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে শত্রু বাহিনীকে পরাজিত করেন।

বনী সাকীফ গোত্র ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহর (সা) হাতে বাইইয়াতের উদ্দেশ্যে মদীনায় এলো। মদীনার উপকন্ঠে মুগীরা উট চরাচ্ছিলেন, সর্বপ্রথম তাঁর সাথেই সাকীফ গোত্রের লোকদের দেখা হল। মুগীরা তাদের দেখেই রাসূলুল্লাহকে (সা) এ সুসংবাদটি দেওয়ার জন্য দৌড় দিলেন। পথে আবু বকরের (রা) সাথে দেখা হলে তাঁকে সংবাদটি দিলেন।

তিনি মুগীরাকে কসম দিয়ে অনুরোধ করলেন, তুমি আমার আগে রাসূলুল্লাহকে (সা) এ সুসংবাদটি দিওনা। সর্বপ্রথম আমিই রাসূলুল্লাহকে (সা) বিষয়টি অবহিত করতে চাই। মুগীরা তাঁর অনুরোধ রক্ষা করলেন। আবু বকরই (রা) সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহর (সা) কানে সুসংবাদটি পৌঁছালেন। তারপর মুগীরা সাকীফ গোত্রের নিকট পৌঁছে ইসলামী কায়দায় কিভাবে রাসূলুল্লাহকে (সা) সালাম করতে হবে তা তাদেরকে শিক্ষা দিলেন।

(হায়াতুস সাহাবা ১/১৮৪) রাসূলুল্লাহর (সা) ওফাতের পর দাফন-কাফনের সময় হাজির ছিলেন। রাসূলুল্লাহর (সা) পবিত্র মরদেহ লোকেরা কবরে নামিয়ে যখন ওপরে উঠে এসেছে, হঠাৎ তিনি ইচ্ছা করে নিজের আংটিটি কবরের মধ্যে ফেলে দিলেন। হযরত আলী (রা) তাঁকে আংটিটি উঠিয়ে আনতে বললেন। তিনি কবরে নেমে রাসূলুল্লাহর (সা) পবিত্র পা হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন। তারপর ধীরে ধীরে যখন মাটি চাপা দেওয়া হচ্ছিল, তিনি কবর থেকে উঠে আসলেন।

রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে সর্বশেষ বিদায়ী ব্যক্তির সম্মান ও গৌরবের অধিকারী হওয়ার উদ্দেশ্যেই তিনি এ কাজ করেছিলেন তিনি প্রায়ই মানুষের কাছে গর্বের সাথে বলতেন, আমি তোমাদের সকলের শেষে রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি। (তাবাকাত) হযরত রাসূলে কারীমের ওফাতের পর প্রথম দুই খলীফার যুগে অধিকাংশ যুদ্ধে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। হযরত আবু বকরের (রা) নির্দেশে সর্বপ্রথম তিনি ‘বাহীরা’ অভিযানে যান। ইয়ামামার ধর্মত্যাগীদের নির্মূল করার ব্যাপারেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। ভণ্ড নবীদের বিদ্রোহ দমনের পর তিনি ইরাক অভিযানে অংশগ্রহণ করেন।

‘বুয়াইব’ বিজয়ের পর মুসলিম বাহিনী কাদেসিয়ার দিকে অগ্রসর হলে পারস্য সেনাপতি বিখ্যাত বীর রুস্তম আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে মুসলমানদের প্রতিনিধি পাঠানোর অনুরোধ জানায়। তার প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে একাধিক দূতের যাতাযাত চললো। সর্বশেষ এ দায়িত্ব অর্পিত হয় হযরত মুগীরার ওপর। পারসিকরা মুসলিম দূতকে ভীত ও আতঙ্কিত করে তোলার জন্য সেনাপতি রুস্তমের দরবারে খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে সজ্জিত করে।

পারস্য বাহিনীর সকল অফিসার রেশমের বহুমূল্য পোশাক পরিধান করে। স্বয়ং রুস্তম স্বর্ণখচিত মুকুট মস্তকে ধারণ করে গর্বভরে মঞ্চের ওপর উপবিষ্ট হয়। দামী কার্পেটে সমগ্র দরবার আচ্ছাদিত হয়। হযরত মুগীরা দরবারে পৌঁছে নিঃসংকোচে সোজা মঞ্চের ওপর উঠে রুস্তমের পাশে বসে পড়েন। এমন সাহসিকতার সাথে তাঁকে বসতে দেখে রুস্তমের পরিষদবর্গ ভীষণ বিরক্ত হয়। তারা মুগীরার হাত ধরে টেনে এনে মঞ্চের নীচে বসিয়ে দেয়।

মুগিরা বললেনঃ “আমরা আরববাসী, আমাদের সেখানে এক ব্যক্তি খোদা হবে, আর অন্যরা তার পূজা করবে এমন বিধান নেই। আমরা সকলে সমান। তোমার আমাদের ডেকে এনেছো, আমরা উপযাচক হয়ে এখানে আসিনি। তোমাদের এমন আচরণ কি যুক্তিসম্মত? তোমাদের অবস্থা যদি এমন থাকে, খুব শিগগির তোমরা বিলীন হয়ে যাবে। আমি বুঝলাম, তোমাদের শাসন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং তোমাদের পরাজয় অনিবার্য এবং এমন বুদ্ধির কোন সাম্রাজ্য টিকে থাকতে পারে না।” দরবারের নীচ শ্রেণীর লোকেরা মন্তব্য করলো, এই আরবী লোকটি সত্য কথাই বলেছে।

ইরানীরা এমন সাম্যের সাথে পরিচিত ছিল না। মুগীরার কথা শুনে তারা একটু দমে গেল। রুস্তমও একটু লজ্জিত হল। সে বললো, এটা চাকর-বাকরদের ভুল। তারপর মুগীরাকে খুশী করার উদ্দেশ্যে মুগীরার তুনির থেকে তীর বের করে রসিকতার সুরে জিজ্জেস করে, ‘এ দিয়ে কি হবে?’ মুগীরা জবাব দিলেনঃ ‘স্ফুলিঙ্গ ক্ষুদ্র হলেও তা আগুন।’ রুস্তম এবার মুগীরার তরবারির দিকে ইঙ্গিত করে বলে, ‘তোমার এই তলোয়ারটি তো অনেক পুরানো।

’ মুগীরা বললেন, ‘বাঁট পুরনো হলেও ধার আছে।’ এরপর মূল বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। রুস্তম স্বজাতির শৌর্য বীর্য, শক্তি ও ক্ষমতা এবং আরবদের তুচ্ছতা ও দারিদ্র্যের উল্লেখ করে বলে, ‘তোমরা আমাদের প্রতিবেশী, তোমাদের সাথে আমরা ভালো ব্যবহার করে থাকি, তোমাদের বিপদ-আপদও আমরা দেব না। আর তোমাদের প্রত্যেক সৈনিকক তাদের মর্যাদা অনুসারে আমরা উপঢৌকন দেব।’ মুগীরা বললেনঃ “দুনিয়া আমাদের উদ্দেশ্যে নয়, আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আখিরাত।

আল্লাহ আমাদের নিকট একজন নবী পাঠিয়েছেন। আল্লাহ তাঁকে বলেছেনঃ যারা আমার দ্বীন গ্রহণ করবে না, আমি তাদের উপর এই দলটিকে বিজয়ী করবো, এদের দ্বারা তাদের থেকে প্রতিশোধ নেব। তারা যতদিন দ্বীন আঁকড়ে থাকবে, আমি তাদের বিজয়ী রাখবো। অপমানিত ব্যক্তিরা এ দ্বীন প্রত্যাখ্যান করবে এবং সম্মানিত তা আঁকড়ে থাকবে।” রুস্তমঃ ‘সেই দ্বীন কি?’ মুগীরাঃ ‘সেই দ্বীনের ভিত্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ – আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, এই কথার শাহাদাত বা সাক্ষ্য এবং আল্লাহর নিকট থেকে যা কিছু এসেছে তার স্বীকৃতি দান।’

রুস্তমঃ‘এ তো খুব চমৎকার কথা! আর কি?’ মুগীরাঃ‘প্রতিটি মানুষই আদমের সন্তান, প্রত্যেকেই আমরা ভাই-ভাই।’ রুস্তমঃ ‘কী চমৎকার! যদি আমরা তোমাদের দ্বীন গ্রহণ করি তোমরা কি তোমাদের দেশে ফিরে যাবে?’ মুগীরাঃ ‘আল্লাহর কসম, আমরা ফিরে যাব। তারপর ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য কোন প্রয়োজন ছাড়া আমরা তোমাদের দেশের কাছেই ঘেঁষবো না।’ রুস্তমঃ ‘খুবই ভালো কথা!’ বর্ণনাকারী বলেন, মুগীরা বের হয়ে গেলে রুস্তম তার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে ইসলাম সম্পর্কে আলোচনা করে। তারা ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। আল্লাহ তাদের অকল্যাণ ও লাঞ্ছিত করেন।

অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, আলোচনার এক পর্যায়ে রুস্তম বলেঃ ‘আমরা তোমাদের হত্যা করবো।’ মুগীরা বলেনঃ ‘তোমরা আমাদের হত্যা করলে আমরা জান্নাতে প্রবেশ করবো, আর আমরা তোমাদের হত্যা করলে তোমাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম এবং তোমরা তখন জিযিয়া দানে বাধ্য হবে।’ জিযিয়ার কথা শুনে তারা চিৎকার করে ওঠে। মুগীরা বলেনঃ ‘জিযিয়া’ দানে অস্বীকৃত হলে তরবারিই হবে তোমাদের ও আমাদের শেষ ফয়সালা।’

এমন কঠোর উত্তরে রুস্তম ক্রোধোম্মত্ত হয়ে পড়ে। সে বলেঃ ‘সূর্যের শপথ! আগামীকাল সূর্যোদয়ের পূর্বেই তোমাদের সেনাবাহিনী নাস্তানাবুদ করে ফেলা হবে।’ মুগীরা বলেনঃ ‘নদী পার হয়ে তোমরা আমাদের দিকে যাবে, না আমরা তোমাদের দিকে আসবো?’ রুস্তমঃ ‘আমরাই নদী পার হয়ে তোমাদের দিকে যাব।’ এই আলোচনার পর মুগীরা শিবিরে ফিরে আসেন। মুসলিম সৈনিকরা একটু পিছু হটে পারস্য বাহিনীকে নদী পার হওয়ার সুযোগ করে দেয়।

এ যুদ্ধে হযরত মুগীরা অংশগ্রহণ করেন এবং পারস্য বাহিনী শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। (হায়াতুস সাহাবা-১/২২০, ২২২-২৩, ৩/৬৮৭-৯২, তারীখুল উম্মাহ আল-ইসলামিয়্যাহ-১/২০৯)। হিজরী উনিশ সনে রায়, কাওমাস ও ইসপাহানবাসীরা শাহানশাহ ইয়াযদিগিরদের সাথে যোগাযোগ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষাট হাজার সৈন্যের এক বাহিনী গড়ে তোলে। হযরত আম্মার বিন ইয়াসির খলীফা উমারকে (রা) বিষয়টি জরুরী ভিত্তিতে অবহিত করেন। বাহিনীসহ খলীফা নিজেই রওয়ানা হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন; কিন্তু অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলার কথা চিন্তা করে সে ইচ্ছা ত্যাগ করেন।

তিনি বসরা ও কূফার আমীরদ্বয়কে নির্দেশ দেন, তারা যেন নিজ নিজ বাহিনীসহ নিহাওয়ান্দের দিকে অগ্রসর হয়। তিনি নু’মান ইবন মুকাররিনকে সেনাপতি নিয়োগ করে হিদায়াত দেন, যদি তুমি শহীদ হও, হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান হবে তোমার স্থলভিষিক্ত। হুজাইফা শহীদ হলে জারীর ইবন আবদিল্লাহ আল বাজালী তার স্থলাভিষিক্ত হবে, আর সে শহীদ হলে মুগীরা ইবন শু’বা পতাকা তুলে ধরবে।

মুসলিম সৈন্যরা নিহাওয়ান্দের নিকটে ছাউনী ফেলার পর ইরানীরা আবারো আলাপ আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে একজন দূত পাঠানোর অনুরোধ জানায়। যেহেতু পূর্বেই একবার সাফল্যের সাথে মুগীরা দৌত্যগিরির দায়িত্ব পালন করেছিলেন, এ কারণে দ্বিতীয়বার এ দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁকেই নির্বাচন করা হয়। দূত হিসাবে ইরানীদের দরবারে উপস্থিত হয়ে দেখলেন, অবস্থা আগের মতই। ইরানী সেনাপতি স্বর্ণখচিত মুকুট পরে মঞ্চে বসে আছে।

দরবারের অন্যান্য সিপাহী সান্ত্রীরা চকচকে তরবারি কাঁধে ঝুলিয়ে ভাব-গম্ভীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। সমগ্র দরবারের নিস্তব্ধ-নীরব। মুগীরা কারো প্রতি কোন রকম ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা ঢুকে গেলেন। পথে প্রহরীরা বাধা দিতে চাইলো। তিনি তাদের বিললেন, ‘দূতের সাথে এমন আচরণ শোভনীয় নয়।’ আলোচনা শুরু হল।

পারস্য সেনাপতি মারওয়ানশাহ বললো, “তোমরা আরবের অধিবাসী, তোমাদের অপেক্ষা অধিক হতভাগ্য, দারিদ্রপীড়িত ও অপবিত্র জাতি দুনিয়ার দ্বিতীয়টি নেই। আমর সৈনিকরা অনেক আগেই তোমাদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলতো; কিন্তু তোমরা এত নীচ যে, তোমাদের ক্ষমা করে দেব। অন্যথায় রণক্ষেত্রে তোমাদের লাশ তোমরা তড়পাতে দেখবে।”

হযরত মুগীরা হামদ ও নাতের পর বললেনঃ “তোমার ধারণা মত নিশ্চয় আমরা এক সময় তেমনই ছিলাম। কিন্তু আমাদের রাসূল (সা) আমাদের আদল বা কায়া পাল্টে দিয়েছেন। এখন চতুর্দিকে আমাদের ক্ষেত্র পরিস্কার। যতক্ষণ রণক্ষেত্রে আমাদের লাশ তড়পাতে না থাকবে, আমরা তোমাদের সিংহাসন ও মুকুট ছিনিয়ে নেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারিনে।”

দৌত্যগিরি ব্যর্থ হল। উভয়পক্ষে যুদ্ধের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। হযরত মুগীরাকে নিয়োগ করা হল বাম ভাগের দায়িত্বে। নিহাওয়ান্দের এ যুদ্ধে হযরত নু’মান ইবন মুকাররিন মারাত্মকভাবে আহত হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনতে লাগলেন। কিন্তু মুসলিম বাহিনীর শক্তি, সাহস ও দৃঢ়তায় কোন পরিবর্তন হল না। পারস্য বাহিনী পরাজয় বরণ করলো।

যুদ্ধ শেষে হযরত মা’কাল দেখতে গেলেন হযরত নু’মান ইবন মুবাররিনকে। তখনও তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস চলছিল, দৃষ্টিশক্তিও কাজ করছিল। তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কয়ে?’ মা’কাল নিজের পরিচয় দিলেন। নু’মান জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘যুদ্ধের ফলাফল কি?’ মাকাল বললেনঃ ‘আল্লাহ আমাদের বিজয় দান করেছেন।’ তিনি বললেনঃ ‘আল-হামদুলিল্লাহ – সকল প্রশংসা আল্লাহর। উমারকে অবহিত কর।’

এ কথাগুলো বলেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নিহাওয়ান্দের পর বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন বাহিনী পাঠিয়ে ব্যাপক অভিযান চালানো হয়। হামদান অভিযানের সার্বিক দায়িত্ব হযরত মুগীরার ওপর অর্পিত হয়। অত্যন্ত সাফল্যের সাথে তিনি হামদানবাসীদের পরাজিত করে তাদেরকে সন্ধি করতে বাধ্য করেন। ইয়ারমুকের যুদ্ধেও তিনি যোগ দেন।

এ যুদ্ধে তিনি চোখে মারাত্মক আঘাত পান। (আল-ইসাবা-৩/৪৫৩, উসুদুল গাবা-৪/৪০১) বসরা শহর পত্তনের পর হযরত উমার (রা) তাঁকে সেখানকার ওয়ালী নিয়োগ করেন। তিনি বসরার ওয়ালী থাকাকালীন অনেক নিয়ম-পদ্ধতি চালু করেন। সৈনিকদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি দেওয়ার জন্য সর্বপ্রথম বসরায় একটি পৃথক ‘দিওয়ান’ বা দফতর প্রতিষ্ঠা করেন। (আল-ইসাবা-৩/৪৫৩) কিছুদিন পর তাঁর চরিত্রের প্রতি মারাত্মক এক দোষারোপের কারণে খলিফা উমার (রা) ওয়ালীর পদ থেকে তাঁকে বরখাস্ত করেন।

তদন্তের পরে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। (উসুদুল গাবা-৪/৪০৬) রাসূলুল্লাহর (সা) একজন সাহাবী তাঁর প্রতি আরোপিত জঘন্য অভিযোগ থেকে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় হযরত উমার (রা) অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে আল্লাহর প্রশংসা আদায় করেন। এ ঘটনার পর হযরত উমার (রা) তাঁকে আম্মার ইবন ইয়াসিরের (রা) স্থলে কূফার ওয়ালী নিয়োগ করেন।

হযরত উমারের খিলাফতের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। হযরত উসমান (রা) তাঁকে উক্ত পদ থেকে বরখাস্ত করেন। (উসুদুল গাবা – ৪/৪০৭) খলীফা হযরত উসমানকে (রা) তিনি সবসময় সৎ পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতেন। ইমাম আহমাদ মুগীরা থেকে বর্ণনা করেছেন। হযরত উসমান যখন গৃহবন্দী তখন মুগীরা একদিন তাঁর কাছে গেলেন। তিনি খলীফাকে বললেন, ‘আপনি জনগণের ইমাম বা নেতা। আপনার ওপর যা আপতিত হয়েছে, তা আপনি দেখতেই পাচ্ছেন।

আমি আপনাকে তিনটি পন্থার কথা বলবো, এর যে কোন একটি গ্রহণ করুন। ১ আপনি ঘর থেকে বের হয়ে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করুন। ২ আপনি বাড়ীর পেছন দরজা দিয়ে গোপনে বের হয়ে বাহনে আরোহণ করুন এবং সোজা মক্কায় চলে যান। সেখানে আপনার কোন ক্ষতি করবে না। ৩ আপনি সিরিয়া চলে যান। কারণ, সেখানে মুয়াবিয়া আছেন।

জবাবে খলীফা উসমান বললেনঃ প্রথমতঃ আমি রাসূলুল্লাহর (সা) উম্মাতের মধ্যে প্রথম রক্তপাতকারী হতে চাই না। দ্বিতীয়তঃ আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) বলতে শুনেছিঃ একজন কুরাইশ ব্যক্তিকে মক্কায় কবর দেওয়া হবে, তার ওপর বিশ্বের অর্ধেক আযাব বা শাস্তি আপতিত হবে। আমি অবশ্যই সেই ব্যক্তি হতে চাই না। তৃতীয়তঃ দারুল হিজরাহ ও মুজাবিরাতু রাসূলিল্লাহ – হিজরাতস্থল ও রাসূলুল্লাহর (সা) নৈকট্য (মদীনা) ত্যাগ করে সিরিয়া যেতে আমি ইচ্ছুক নই। (হায়াতুস সাহাবা-২/৩৯৬)

 

হযরত আলী (রা) ও হযরত মুয়াবিয়ার (রা) মধ্যে বিরোধ শুরু হল। প্রথম দিকে হযরত মুগীরা (রা) হযরত আলীর (রা) পক্ষে ছিলেন। তিনি আলীর (রা) খিদমতে হাজির হয়ে সরলভাবে পরামর্শ দেন, “যদি আপনি আপনার খিলাফত শক্তিশালী করতে চান তাহলে তালহা-যুবাইরকে যথাক্রমে কুফা ও বসরার ওয়ালী নিয়োগ করুন। আর আমীর মুয়াবিয়াকে তার পূর্ব পদে আপাততঃ বহাল রাখুন, তারপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যা ইচ্ছা হয় করবেন।

” হযরত আলী (রা) তাঁকে জবাব দেন, “তালহা-যুবাইরের ব্যাপারে ভেবে দেখবো; তবে মুয়াবিয়া যতদিন তার বর্তমান কার্যকলাপ বন্ধ না করবে, আমি তাঁকে না কোথাও ওয়ালী নিযুক্ত করবো, না তার কোন সাহায্যগ্রহণ করবো।” এই জবাবে মুগীরা ক্ষুব্ধ হন। (আল-ইসতিয়াব) হযরত উসমানের (রা) হত্যার পর মুসলিম উম্মাহর দু’ বিবদমান পক্ষের মধ্যে সংঘাত সংঘর্ষ হয়। তিনি এসব সংঘর্ষ থেকে সযত্নে দূরে থাকেন।

সিফফীনের পর দু’মাতুল জান্দালে সালিশী রায় শোনার জন্য তিনিও উপস্থিত ছিলেন। দু’মাতুল জান্দালে সালিশী ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি হযরত মুয়াবিয়ার (রা) পক্ষে যোগদান করেন এবং তার হাতে বাইয়াত বা আনুগত্যের শপথ করেন। এরপর থেকে তিনি প্রকাশ্যে হযরত আলীর (রা) বিরোধিতা শুরু করেন। (আল-ইসাবা ৩/৪৫৩,

মুসতাদরিক-৩/৪৫০) হযরত মুগীরার (রা) সমর্থন ও সহযোগিতা হযরত মুয়াবিয়ার বিশেষ উপকারে আসে। অনেক বড় বড় সমস্যা তিনি তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সাহায্যে খুব তাড়াতাড়ি সমাধান করে দেন। খিলাফতের ব্যাপারে আমীর মুয়াবিয়ার (রা) সামনে এমনসব কঠিন সমস্যা উপস্থিত হয়েছে, তখন যদি মুগীরার বুদ্ধি ও মেধা কাজ না করতো তাহলে হযরত মুয়াবিয়াকে অত্যন্ত মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন হতে হতো।

যিয়াদ ছিলেন আরবের অতি চালাক ও কৌশলী লোকদের মধ্যে অন্যতম প্রধান পুরুষ। তিনি ছিলেন হযরত আলীর (রা) পক্ষ থেকে পারস্যের ওয়ালী এবং হযরত মুয়াবিয়ার (রা) চরম বিরোধী। হযরত আলীর (রা) শাহাদাতের পর হযরত হাসান (রা) খিলাফতের দাবী থেকে সরে দাঁড়ানোর পর হযরত মুয়াবিয়া (রা) যখন সমগ্র মুসলিম জাহানের একচ্ছত্র খলীফা, তখনও যিয়াদ তাঁকে খলীফা বলে স্বীকার করেননি। হযরত মুগীরা এমন কট্টর দুশমনকেও হযরত মুয়াবিয়ার (রা) অনুগত বানিয়ে দেন এবং মুয়াবিয়াকে এক মারাত্মক বিপদ থেকে রক্ষা করেন।

হিজরী ৪১ সনে হযরত আমীর মুয়াবিয়া বিশেষ অবদানের পুরস্কার স্বরূপ হযরত মুগীরাকে কূফার ওয়ালী নিয়োগ করেন। হিজরী ৩৩ সনে কূফার খারেজীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সেই বিদ্রোহ দমন করেন। এভাবে তিনি হযরত মুয়াবিয়ার (রা) খিলাফত শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করেন। হযরত মুগীরার মৃত্যু সন সম্পর্কে মতভেদ আছে।

অনেকে বলেছেন, হিজরী ৫০ সনে কূফায় যে প্লেগ দেখা দেয় সেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন হিজরী ৪৯/৫১ সনে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ (সত্তর) বছর। হযরত মুগীরা (রা) যদিও একজন বিজ্ঞ কূটনীতিক ও সৈনিক ছিলেন, তথাপি দ্বীনি বিদ্যায় যথেষ্ট পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। সমবয়সীদের মধ্যে অগাধ জ্ঞানের জন্য তাঁর একটা বিশেষ মর্যাদা ছিল। হাদীসের বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁর বর্ণিত (১৩৩) টি হাদীস দেখা যায়।

তারমধ্যে ৯টি মুত্তাফাক আলাইহি, একটি বুখারী ও দু’টি মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন। বহু সাহাবী ও তাবেঈ তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। যেমনঃ তাঁর তিন পুত্র – উরওয়া, হামযা, আককার এবং অন্যান্যের মধ্যে যুবাইর ইবন ইয়াহয়িয়া, মিসওয়ার ইবন মাখরাম, কায়েস ইবন আবী হাযেম, মাসরূক ইবন আজদা, নাফে ইবন হুবায়রা, উরওয়া ইবন যুবাইর, আমর ইবন ওয়াহহাব প্রমুখ ব্যাক্তিবর্গ।

দ্বীনী জ্ঞানে পারদর্শী হওয়া সত্বেও তিনি ইলম ও ইফতা’র মসনদের পরিবর্তে রাজনীতি ও কূটনীতির জটিল ময়দানে বিচরণ করেন। এ অঙ্গনেই তাঁর প্রতিভা ও যোগ্যতার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। তাঁকে আরবের শ্রেষ্ঠতম কূটনীতিকদের মধ্যে গণ্য করা হয়। ইমাম শা’বী বলেন, আরবের অতি চালাক ব্যক্তি চারজন – মুয়াবিয়া ইবন আবী সুফইয়ান, আমর ইবনুল আস মুগীরা ইবন শুবা ও যিয়াদ। (উসুদুল গাবা-৪/৪০৭, আল ইসাবা ৩/৪৫৩) ইবন সা’দ বলেন, তাঁর অসাধারণ বুদ্ধি ও মেধার কারণে লোকে তাঁকে ‘মুগীরাতুল রায়’ মতামত বা সিদ্ধান্তের অধিকারী মুগীরা বলে উল্লেখ করতো। (আল-ইসতিয়াব) এ সকল অসাধারণ গুণের কারণে হযরত উমার (রা) তাঁকে অনেক বড় বড় পদে নিয়োগ করেন।

এমন কি ইরানী দরবারে দৌত্যগিরির দুর্লভ সম্মানও অর্জন করেন। কাবীসা ইবন জাবির বলেন, আমি দীর্ঘদিন মুগীরার সাহচর্যে কাটিয়াছি। তিনি এত বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান ছিলেন যে, যদি কোন শহরের এমন আটটি দরজা থাকে যে, তার কোন একটির ভেতর দিয়েও কৌশল ও চাতুর্য ছাড়া বের হওয়া যায় না, মুগীরা তার প্রত্যেকটি দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম ছিলেন। জটিল বিষয়ের জট খোলার ব্যাপারে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাবারী বলেন, কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত ব্যক্তকালে তা থেকে সরে আসার পথও বের করে রাখতেন। যখনই কোন দু’টি বিষয় সংশয়পূর্ণ হয়ে পড়তো, অবশ্যই একটির ব্যাপারে তাঁর সঠিক রায় প্রকাশ পেত। (আল-ইসাবা ৩/৪৫৩)

হযরত মুগীরার চাতুর্য ও কূটনীতির বহু কৌতুকপূর্ণ ঘটনা ইতিহাসে দেখা যায়। হযরত উমার (রা) তাঁকে বাহরাইনের ওয়ালী নিয়োগ করেন। বাহরাইনবাসীরা তাঁর বিরুদ্ধে খলীফার নিকট অভিযোগ উত্থাপন করে। হযরত উমার তাঁকে বরখাস্ত করেন। তিনি যাতে দ্বিতীয়বার সেখানে ওয়ালীর পদে নিয়োগ না পান সেজন্য সেখানকার দাহকান বা সরদার এক মারাত্মক ষড়যন্ত্রকরে।

সে এক লাখ দিরহাম সংগ্রহ করে খলীফার নিকট জমা দিয়ে বলে, ‘মুগীরা বাইতুল মাল থেকে এ অর্থ আত্মসাৎ করে আমার কাছে জমা রেখেছিলেন।’ হযরত উমার অত্যন্ত কঠোরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। বিষয়টি ছিল অত্যন্ত নাজুক। একদিকে রাসূলুল্লাহর (সা) সাহাবী, অন্যদিকে অসংখ্য লোক তাঁর বুরুদ্ধে সাক্ষী, আত্মসাৎকৃত অর্থও উপস্থিত। দোষ প্রমাণের জন্য অতিরিক্ত কোন সাক্ষী-সাবুতের প্রয়োজন নেই।

এমন পরিস্থিতিতেও মুগীরা বুদ্ধির ভারসাম্য বজায় রাখেন। অত্যন্ত ধীর স্থিরভাবে তিনি বলেন, দাহকান বা সরদার মিথ্যা বলেছে। আমি তো তার নিকট দু’লাখ জমা রেখেছিলাম, একলাখ সে আত্মসাৎ করেছে।’ একথা শুনে ‘দাহকান’ ভয়ে মুষড়ে পড়ে। এখন তো তাকে দু’লাখই বাইতুল মালে জমা দিতে হবে। সে অকপটে তার কারসাজির কথা স্বীকার করে। বার বার কসম খেয়ে বলতে থাকে, ‘মুগীরা আমার কাছে কোন অর্থই জমা রাখেননি।’ এভাবে সত্য প্রকাশ হয়ে পড়ে।

মুগীরার দুর্নাম রটানোর জন্য সে মনগড়া কাহিনী তৈরী করেছিল,বিষয়টি মিটমাট হয়ে যাওয়ার পর হযরত উমার (রা) মুগীরাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি দু’লাখের কথা স্বীকার করলে কেন?’ তিনি বললেন, ‘সে আমার প্রতি মিথ্যা দোষারোপ করেছিল, এভাবে ছাড়া তার বদলা নেওয়ার আমার আর কোন উপায় ছিল না’। (আল-ইসাবা ৩/৪৫৩) প্রখ্যাত সাহাবী নু’মান ইবন মুকাররিন (রা) একবার মুগীরাকে বলেন, ‘ওয়াল্লাহি ইন্নাকা লাজু মানাকিব – অর্থাৎ তুমি বুদ্ধিমত্তা, পরামর্শদান ও সঠিক মতামতের অধিকারী ব্যক্তি।’ (হায়াতুস সাহাবা – ১/৫১২) আবদুর রহমান ইবন আবী বকর (রা) তাঁর ইসলাম-পূর্ব যুগের নাম আবদুল কা’বা, মতান্তরে আবদুল উযযা। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর নাম রাখেন আবদুর রহমান। তাঁর ডাক নাম বা কুনিয়াত তিনটিঃ আবু আবদিল্লাহ, তাঁর পুত্র মুহাম্মাদের নামানুসারে আবু মুহাম্মাদ ও আবু উসমান

তবে আবু আবদিল্লাহ সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। পিতা প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) ও মাতা উম্মু রুমান বা উম্মু রূম্মান। পিতার জ্যেষ্ঠ সন্তান এবং উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশার (রা) সহোদর। (উসুদুল গাবা-৩/৩০৪-৩০৫) হযরত আবু বকর সুদ্দীকের সন্তানদের সকলে প্রথম ভাগেই ইসলাম গ্রহণ করলেও আবদুর রহমান দীর্ঘদিন পর্যন্ত ইসলাম থেকে দূরে থাকেন। বদর যুদ্ধে মক্কার কুরাইশদের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন।

যুদ্ধের মাঝামাঝি পর্বে তিনি একটু সামনে এগিয়ে এসে মুসলমানদের প্রতি চ্যালেঞ্জের সুরে বললেনঃ ‘হাল মিন মুবারিযিন’ – আমার সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধের সাহস রাখে এমন কেউ কি আছ? তাঁর এ চ্যালেঞ্জ শুনে পিতা আবু বকরের (রা) চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। তিনি তাঁর সাথে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন, কিন্তু হযরত রাসূলে কারীম (সা) তাঁকে নিবৃত্ত করেন।

উহুদের যুদ্ধেও তিনি মক্কার কুরাইশদের সাথে ছিলেন। এ যুদ্ধে তিনি ছিলেন কুরাইশদের তীরন্দায বাহিনীর অন্যতম সদস্য। (উসুদুল গাবা-৩/৩০৫) পরবর্তীকালে একদিন আবদুর রহমান পিতা আবু বকরকে (রা) বলেন উহুদের ময়দানে আমি আপনাকে পেয়েও এড়িয়ে গিয়েছিলাম।

জবাবে আবু বকর (রা) বলেন, আমি তোমাকে দেখলে ছেড়ে দিতাম না। (হায়াতুস সাহাবা-২/৩১৩) হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় হযরত আবদুর রহমান ইসলাম গ্রহণ করেন। তারপর মদীনায় হিজরাত করে পিতা আবু বকরের (রা) সাথে বসবাস করতে থাকেন। হযরত আবু বকরের (রা) যাবতীয় কাজ কারবার তিনিই দেখাশুনা করতেন। একবার রাত্রিবেলা হযরত আবু বকর (রা) আসহাবে সুফফার কতিপয় লোককে দাওয়াত করলেন।

তিনি আবদুর রহমানকে বললেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহর (সা) খিদমতে যাচ্ছি, আমার ফিরে আসার পূর্বেই তুমি মেহমানদের খাইয়ে দেবে।’ পিতার নির্দেশমত আবদুর রহমান যথাসময়ে মাহমানদের সামনে খাবার হাজির করলেন। কিন্তু তাঁরা মেযবানের অনুপস্থিতিতে খেতে অস্বীকার করলেন। ঘটনাক্রমে সেদিন হযরত আবু বকর (রা) দেরীতে ফিরলেন।

ফিরে এসে যখন জানলেন, মেহমানরা এখনও অভুক্ত রয়েছে, তিনি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে আবদুর রহমানকে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! তোকে আমি খাবার দেব না।’ আবদুর রহমান ভয়ে জড়সড় হয়ে বাড়ীর এক কোণে বসে ছিলেন। একটু সাহস করে তিনি বললেন, ‘আপনি মেহমানদের একটু জিজ্ঞেস করুন, আমি তাঁদের খাওয়ার জন্য সেধেছিলাম কিনা।’

মেহমানরা আবদুর রহমানের কথা সমর্থন করলেন। তাঁরাও কসম খেয়ে বললেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আবদুর রহমানকে খেতে না দেবেন, আমরা খাবনা।’ এভাবে আবু বকরের রাগ প্রশমিত হয় এবং সকলে এক সাথে বসে আহার করেন। আবদুর রহমান বলেন, “সেদিন আমাদের খাবারে এত বরকত হয়েছিল যে, আমরা খাচ্ছিলাম, কিন্তু তা মোটেই কমছিল না। আমি সেই খাবার থেকে কিছু রাসূলুল্লাহর (সা) জন্য নিয়ে গেলাম। রাসূলুল্লাহ (সা) বেশ কিছু সাহাবীসহ তা আহার করেন।” (বুখারী)

স্বভাবগত ভাবেই হযরত আবদুর রহমান ছিলেন অত্যন্ত সাহসী। তিনি ছিলেন দক্ষ তীরন্দায। হুদাইবিয়ার সন্ধির পর থেকে রাসূলুল্লাহর (সা) জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যত যুদ্ধ হয়, তিনি প্রত্যেকটিতে অংশগ্রহণ করে বীরত্ব ও সাহসিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। খাইবার অভিযানে তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সহযাত্রী হন এবং খাইবারের গনীমাত থেকে চল্লিশ ‘ওয়াসাক’ খাদ্যশস্য লাভ করেন। (সীরাতু ইবন হিশাম ২/৩৫২) বিদায় হজ্জেও তিনি রাসূলুল্লাহর (সা) সফরসঙ্গী ছিলেন। হযরত রাসূলে কারীম (সা) তাঁকে হযরত আয়িশার (রা) সাথে ‘তানয়ীমে’ পাঠিয়েছিলেন নতুন করে ইহরাম বাঁধার জন্য।

উল্লেখ্য যে হযরত আয়িশা (রা) এ সফরে ঋতুবতী হওয়ার কারণে হজ্জের কিছু অবশ্য পালনীয় কাজ স্থগিত রেখে ইহরাম ভেঙ্গে ফেলেন। সুস্থ হওয়ার পরে রাসূলুল্লাহর (সা) নির্দেশে ‘তানয়ীমে’ গিয়ে পুনরায় ইহরাম বেঁধে স্থগিত কাজগুলি সম্পাদন করেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-২/৬০২) রাসূলুল্লাহর (সা) ইনতিকালের পর আরব উপদ্বীপের চতুর্দিকে যে বিদ্রোহ দেখা দেয় তা দমনে তিনি অন্যদের সাথে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

ভণ্ড-নবী মুসাইলামা আল কাজ্জাবের সাথে ইয়ামামার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তিনি চরম বীরত্বের পরিচয় দেন। এ যুদ্ধে তিনি শত্রুপক্ষের সাতজন বিখ্যাত বীরকে একাই হত্যা করেন। ইয়ামামার শত্রুপক্ষের দুর্গের এক স্থানে ফেটে ছোট্ট একটি পথ হয়ে গিয়েছিল। মুসলিম মুজাহিদরা বার বার সেই ছিদ্র পথ দিয়ে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছিল। কারণ, শত্রুপক্ষের মাহকাম ইবন তুফাইল নামক এক বীর সৈনিক অটলভাবে পথটি পাহারা দিচ্ছিল।

হযরত আবদুর রহমান তার সিনা তাক করে একটি তীর নিক্ষেপ করেন এবং সেই তীরের আঘাতে সে মাটিতে ঢলে পড়ে। মুসলিম মুজাহিদরা সাথে সাথে সঙ্গীদের পায়ে পিষতে পিষতে ভেতরে প্রবেশ করে দুর্গের দরজা খুলে দেন। এভাবে দুর্গের পতন হয়। হযরত উসমানের শাহাদাতের পর হযরত আলী ও হযরত আয়িশার (রা) মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির কারণে যে উটের যুদ্ধ হয়, সেই যুদ্ধে আবদুর রহমান বোনের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন। (আল-ইসাবা-২/৪০৮) হযরত আমীর মুয়াবিয়া (রা) তাঁর জীবদ্দশাতেই পুত্র ইয়াযিদকে স্থলাভিষিক্ত করার প্রচেষ্টা শুরু করেন। তিনি স্বীয় উত্তরাধিকারী হিসেবে ইয়াযিদের নাম মদীনায় জনগণের বাইয়াত বা আনুগত্যের শপথ নেয়ার জন্য মদীনার ওয়ালী মারওয়ানকে নির্দেশ দিলেন।

তাঁর এ নির্দেশ মদীনার মসজিদে সমবেত লোকদের পাঠ করে শুনানোর কথাও বললেন। মারওয়ান মুয়াবিয়ার (রা) এ আদেশ যথাযথভাবে পালন করলেন। তিনি মসজিদে মদীনার জনগণকে সমবেত করে আমীর মুয়াবিয়ার নির্দেশ পাঠ করে শুনালেন। তাঁর পাঠ শেষ হতে না হতেই হযরত আবদুর রহমান ইবন আবী বকর লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং মজলিসের নীরবতা ভঙ্গ করে গর্জে উঠলেন।

“আল্লাহর কসম! তোমরা উম্মাতে মুহাম্মাদীর মতামতের পরোয়া না করে খিলাফতকে হিরাকলী পদ্ধতিতে রূপান্তরিত করছো। এক হিরাকলের মৃত্যু হলে আর এক হিরাকল তার স্থলাভিষিক্ত হবে।” অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, মারওয়ান বলেনঃ এ তো আবু বকর ও উমার প্রবর্তিত পদ্ধতি। আবদুর রহমান প্রতিবাদ করে বলেনঃ না, এটা হিরাকল ও কায়সারের পদ্ধতি।

পিতার পর পুত্রকে সিংহাসনে বসানোর পদ্ধতি। আবদুল্লাহ ইবন যুবাইর এবং হুসাইন ইবন আলীও আবদুর রহমানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন। (আল-ইসাবা-২/৪০৮, উসুদুল গাবা-৩/৩০৬) মারওয়ান তখন অত্যন্ত উত্তেজিত কন্ঠে আবদুর রহমানের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেনঃ বন্ধুগণ! এ সেই ব্যক্তি যার সম্পর্কে কুরআনের এ আয়াত নাযিল হয়েছেঃ “ যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতাকে বলে, তোমাদের জন্য আফসুস” অর্থাৎ পিতা-মাতার আনুগত্য না করার জন্য আল্লাহ তার নিন্দা করেছেন, সূরা আহকাফ-১৭।

 

উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা (রা) তাঁর হুজরা থেকে তার এ কথা শুনলেন। তিনি উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেনঃ ‘আল্লাহর কসম! না, আবদুর রহমানের শানে নয়। যদি তোমরা চাও, কোন ব্যক্তির শানে এ আয়াতটি নাযিল হয়েছিল, আমি তা বলতে পারি। (আল-ইসাবা ৪/৪০৮, উসুদুল গাবা-৩/৩০৬) হযরত আবদুর রহমান সেদিন উপলব্ধি করেছিলেন, মুয়াবিয়ার (রা) এ ইচ্ছা পূর্ণ হলে মুসলিম উম্মাহ এক মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন হবে।

তিনি নিশ্চিতভাবে বুঝেছিলেন, এটা ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থা উৎখাত করে মুসলিম উম্মাহর ওপর কায়সারিয়্যাহ চাপিয়ে দেয়ার একটি ষড়যন্ত্র। হযরত আবদুর রহমান হযরত মুয়াবিয়ার এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে জোর গলায় প্রতিবাদ জানাতে লাগলেন। হযরত মুয়াবিয়া (রা) এবার ভিন্ন পথ অবলম্বন করলেন। তিনি আবদুর রহমানের কন্ঠরোধ করার জন্য এক লাখ দিরহামসহ একজন দূত তাঁর কাছে পাঠালেন।

হযরত সিদ্দীকে আকবরের পুত্র আবদুর রহমান দিরহামের থলিটি দূরে নিক্ষেপ করে দূতকে বললেনঃ ‘ফিরে যাও। মুয়াবিয়াকে বলবে, আবদুর রহমান দুনিয়ার বিনিময়ে দ্বীন বিক্রি করবে না।’ (আল-ইসতিয়াব, উসুদুল গাবা-৩/৩০৬, হায়াতুস সাহাবা-২/২৫৪, রিজালুন হাওলার রাসূল-৫২৮) এ ঘটনার পর হযরত আবদুর রহমান যখন জানতে পেলেন হযরত মুয়াবিয়া (রা) সিরিয়া থেকে মদীনায় আসছেন, তিনি সাথে সাথে মদিনা ছেড়ে মক্কায় চলে যান।

সেখানে শহর থেকে দশ মাইল দূরে ‘হাবশী’ নামক স্থানে বসবাস করতে থাকেন এবং সর্বাধিক সঠিক মতানুযায়ী হিজরী ৫৩ সনে ইয়াযিদের বাইয়াতের পূর্বেই ইনতিকাল করেন। অত্যন্ত আকস্মিকভাবে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর দিন সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় প্রতিদিনের মত যথারীতি শুয়ে পড়েন; কিন্তু সেই ঘুম থেকে আর জাগেননি। হযরত আয়িশার মনে একটু সন্দেহ হয়, কেউ হয়তো তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছে। এর কিছুদিন পরে এক সুস্থ সবল মহিলা হযরত আয়িশার (রা) নিকট আসে এবং নামাযে সিজদারত অবস্থায় মারা যায়। এ ঘটনার পর তাঁর মনের খটকা দূর হয়ে যায়। হযরত আবদুর রহমানের সঙ্গী-সাথীরা তাঁর লাশ মক্কায় এনে দাফন করে।

হযরত আয়িশা (রা) ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে হজ্জের নিয়তে মক্কায় যান এবং কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কান্নার মধ্যে কবি মুতাম্মিম ইবন নুওয়াইরাহ রচিত একটি শোক গাঁথার শ্লোক বার বার আওড়াচ্ছিলেন। তারপর ভাইয়ের রূহের উদ্দেশ্যে বলেনঃ “আল্লাহর কসম! আমি তোমার মরণ সময় উপস্থিত থাকলে এখন এভাবে কাঁদতাম না এবং যেখানে তুমি মৃত্যুবরণ করেছিলে সেখানেই তোমাকে দাফন করতাম।” (মুসতাদরিক ৩/৪৭৬, আল-ইসাবা-২/৪০৮) হযরত আবদুর রহমান (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে বেশ কিছু হাদীস বর্ণনা করেছেন। বহু সাহাবী ও তাবেঈ তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।

আবু হুজাইফা ইবন উতবা (রা:)

নাম আবু হুজাইফা হাশীম, মতান্তরে হাশেম, পিতা উতবা, মাতা ফাতিমা বিনতু সাফওয়ান এবং ডাকনাম উম্মু সাফওয়ান। কুরাইশ গোত্রের সন্তান।

আবু হুজাইফা সাবেকীনে ইসলাম অর্থাৎ প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম ব্যক্তি। তাঁর পিতা উতবা ইসলামের চরম দুশমন কুরাইশ নেতৃবৃন্দের এক প্রধান পুরুষ। ইসলামের বিরোধিতায় সে তার জীবন উৎসর্গ করেছিল। কিন্তু আল্লাহর কি মহিমা, তারই পুত্র আবু হুজাইফা ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করতে মোটেও বিলম্ব করেননি।

মক্কায় রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত আরকাম ইবন আবিল আরকামের গৃহে আশ্রয় নেওয়ার পূর্বেই তিনি ইসলাম গ্রহণের গৌরব অর্জন করেন এবং আরো অনেকের মত কুরাইশদের হাতে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন। (উসুদুল গাবা-৫/১৭০) ইবন ইসহাক বলেন, তিনি তেতাল্লিশ (৪৩) জনের পর ইসলাম গ্রহণ করেন। (আল- ইসাবা – ৪/৪২)

আবু হুজাইফা (রা) হাবশায় দু’টি হিজারাতেই অংশগ্রহণ করেন। প্রথমবার হিজরাত করে আবার মক্কায় ফিরে আসেন। পরে আবার হাবশায় চলে যান। হাবশায় হিজরাতে তাঁর স্ত্রী হযরত সাহলা বিনতু সুহাইলও সাথী ছিলেন। তাঁদের পুত্র মুহাম্মাদ ইবন আবী-হুজাইফা সেই প্রবাসে হাবশায় জম্মগ্রহণ করেন। (উসুদুল-গাবা – ৫/১৭০)।

হাবশা থেকে দ্বিতীয়বারের মত মক্কায় ফিরে এসে তিনি দেখতে পেলেন, মক্কায় অবস্থানরত মুসলমানদের মধ্যে মদীনায় হিজরাতের হিড়িক পড়ে গেছে। তাঁর দাস সালেমকে সংগে করে তিনিও মদীনায় পৌঁছলেন এবং হযরত আব্বাদ ইবন বিশর আল-আনসারীর অতিথি হলেন। হযরত রাসূলে কারীম (সা) তাঁদের দু’জনের মধ্যে ‘মুওয়াখাত’ বা ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে দেন। (উসুদুল গাবা – ৫/১৭০)।

রাসূলুল্লাহর (সা) সময়ে সংঘটিত সকল যুদ্ধে তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে অংশগ্রহণ করেন। বিশেষতঃ বদর যুদ্ধের ঘটনাটি ছিল তাঁর ও সকল মুসলমানের জন্য দারুন শিক্ষণীয়। এ যুদ্ধে এক পক্ষে তিনি এবং অন্য পক্ষে তাঁর পিতা উতবা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। সত্য ও ন্যায়ের প্রেম সেদিন মুসলমানদেরকে আপন পর সম্পর্ক বিস্মৃত করে দিয়েছিল।

সেদিন আবু হুজাইফা চিৎকার করে আপন পিতা প্রতিপক্ষের দুঃসাহসী বীর উতবাকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধের আহবান জানান। তাঁর এ আহবান শুনে তাঁর সহোদরা হিন্দা বিনতু উতবা একটি কবিতায় তাঁকে ভীষণ তিরস্কার ও নিন্দা করে। উসুদুল গাবা গ্রন্থে কবিতাটির দু’টি পংক্তি সংকলিত হয়েছে।

 

বদর যুদ্ধে আবু হুজাইফার পিতা উতবাসহ অধিকাংশ কুরাইশ নেতা মুসলিম বাহিনীর হাতে নিহত হয় এবং তাদের সকলের লাশ বদরের একটি কূপে নিক্ষেপ করে মাটি চাপা দেওয়া হয়। হযরত রাসূলে কারীম (সা) সেই কূপের কাছে দাঁড়িয়ে নিহত কুরাইশ নেতৃবৃন্দের এক একজন করে নাম ধরে ডেকে বলতে লাগলেন, “ওহে উতবা, ওহে শাইবা, ওহে উমাইয়া ইবনে খালাফ, ওহে আবু জাহল! তোমরা কি আল্লাহর অঙ্গীকার সত্য পেয়েছ? আমি তো আমার অঙ্গীকার সত্য পেয়েছি।” (বুখারী) ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, সে সময় হযরত আবু হুজাইফাকে খুবই উদাস ও বিমর্ষ মনে হচ্ছিল।

 

রাসূলুল্লাহ (সা) তার এ অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করেন, “আবু হুজাইফা, সম্ভবত তোমার পিতার জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে।” আবু হুজাইফা বলেন, “আল্লাহর কসম, না। তাঁর নিহত হওয়ার জন্য আমার কোন দুঃখ নেই। তবে আমার ধারণা ছিল, তিনি একজন বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ ও সিদ্ধান্তদানকারী ব্যক্তি। তাই আমার আশা ছিল, তিনি ঈমান আনার সৌভাগ্য অর্জন করবেন।

কিন্তু রাসূল (সা) যখন তাঁর ‘কুফর’ অবস্থায় মৃত্যুবরণের নিশ্চয়তা দান করলেন, তখন আমার দুরাশার জন্য আফসুস হলো।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) আবু হুজাইফার জন্য দু’আ করলেন। (সীরাতু ইবন হিশাম – ১/৬৩৮-৪১, উসুদুল গাবা – ৫/১৭১)

হযরত রাসূলে কারীমের ওফাতের পর প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দীকের (রা) খিলাফতকালে আরব উপদ্বীপে কতিপয় ভণ্ড নবীর ফিতনা ও উৎপাত শুরু হয়। ইয়ামামার মুসাইলামা কাজ্জাবও ছিল সেইসব ভণ্ড নবীর একজন। খলীফা তার বিরুদ্ধে এক বাহিনী পাঠান। এই বাহিনীতে হযরত আবু হুজাইফাও (রা) ছিলেন। ভণ্ড মুসাইলামার বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করে তিনি ইয়ামামার রণক্ষেত্রে শহীদ হন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৩ অথবা ৫৪ বছর।

 

হযরত আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বদর যুদ্ধের সময় একদিন সাহাবীদের বললেন, “আমি জানতে পেরেছি, বনী হাশেম ও অন্য কতিপয় গোত্রের কিছু লোককে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বাধ্য করা হয়েছে। তাদের সাথে যুদ্ধ করার কোন প্র্যোজন আমাদের নেই। তোমাদের কেউ বনী হাশেমের কোন ব্যক্তির মুখোমুখি হলে তাকেও হত্যা করবে না।

কেউ আবুল বুখতারী ইবন হিশামের দেখা পেলে তাকে হত্যা করবে না। কারণ, তিনি বাধ্য হয়ে এসেছেন।” সংগে সংগে আবু হুজাইফা বলে উঠলেন, “আমরা আমাদের পিতা, পুত্র ও ভ্রাতাদের হত্যা করবো, আর আব্বাসকে ছেড়ে দেব? আল্লাহর কসম, আমি তার সাক্ষাৎ পেলে তরবারি দিয়ে তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবো।” রাসুলুল্লাহ (সা) হুজাইফার এ কথা শুনে বললেন, “ওহে আবু হাফস (উমার), আল্লাহর রাসূলের চাচাকে তরবারি দিয়ে হত্যা করা হবে?” উমার বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাকে অনুমতি দিন, তরবারি দিয়ে আমি তার গর্দান উড়িয়ে দিই।

 

আল্লাহর কসম, সে একজন মুনাফিক।” আবু হুজাইফা বলেন, “সেদিন যে কথাটি বলেছিলাম, সে জন্য আমি নিরাপত্তা বোধ করি না এবং শাহাদাতের মাধ্যমে তার কাফফারা আদায় না করা পর্যন্ত সর্বদা আমি ভীত সন্ত্রস্ত।” ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদ হয়ে তিনি তাঁর কাফফারা আদায় করেন। (হায়াতুস সাহাবা – ২/৩৬৪-৬৫)

হাতিব ইবন আবী বালতা’য়া (রা:)

নাম হাতিব, কুনিয়াত আবু মুহাম্মাদ, আবু আবদিল্লাহ। পিতার নাম আবু বালতা’য়া আমর। তাঁর বংশ পরিচয় ও মক্কায় উপস্থিতির ব্যাপারে সীরাত লেখকদের মতভেদ আছে। সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য মতে পিতৃ-পুরষের আদি বাসস্থান ইয়ামান। বনী আসাদ, অত:পর যুবাইর ইবনুল আওয়ামের হালীফ বা চুক্তিবদ্ধ হয়ে তারা মক্কায় বসবাস করতো।

 

আবার কেউ বলেছেন, তিনি উবাইদুল্লাহ ইবনে হুমাইদের দাস ছিলেন। মুকাতাবা বা চুক্তির ভিত্তিতে অর্থ পরিশোধ করে দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করেন। (উসুদুল গাবা-১/৩৬১)।

মারযুবানী তাঁর মুজামুশ শু’য়ারা গ্রন্থে বলেন, “তিনি জাহিলী যুগে কুরাইশদের অন্যতম খ্যাতিমান ঘোড় সাওয়ার ও কবি ছিলেন”। (আল ইসাবা-১/৩০০)

হিজরাতের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মদীনা ইসলামের কেন্দ্ররূপে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর তাঁর দাস সা’দকে সংগে করে তিনি মদীনায় উপস্থিত হন। সেখানে হযরত মুনজির ইবন মুহাম্মাদ আল আনসারীর অতিথি হন এবং হযরত খালিদ ইবন রাখবালার রা: সাথে মুওখাত বা ভাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়।

মুসা ইবন উকবা ও ইবন ইসহাক বলেন, রাসুলুল্লাহ সা: সাথে তিনি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। হুদাইবিয়ার সন্ধিতেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। (উসুদুল গাবা-১/৩৬১)। তাছাড়া বিভিন্ন বর্ণনা মতে উহুদ, খন্দক সহ রাসুলুল্লাহর সা: সংগে সংঘটিত সকল যুদ্ধে যোগদান করেন।

 

উহুদ থেকে ফিরে হিজরী ষষ্ঠ সনে ইসলামের মুবাল্লিগ বা প্রচারক হিসেবে রাসুলুল্লাহ সা: তাঁকে মিসর অধিপতি মাকুকাসের দরবারে পাঠান। তিনি মাকুকাসের নিকট রাসুলুল্লাহ’র সা: যে পত্রটি বহন করে নিয়ে যান তার বিষয়বস্তু নিম্নরূপ:

“অত:পর আমি আপনাকে ইসলামী দাওয়াতের দিকে আহবান জানাচ্ছি। ইসলাম গ্রহণ করলে আপনি নিরাপদ থাকবেন এবং আল্লাহ আপনাকে দ্বিগুণ বিনিময় দান করবেন। আর যদি প্রত্যাখ্যান করেন তাহলে সকল কিবতীর পাপ আপনার ওপর বর্তাবে।

হে আসমানী কিতাবের অধিকারীরা! আপনারা এমন একটি কালেমা বা কথার দিকে আসুন যা আমাদের ও আপনাদের সকলের জন্য সমান। অর্থাত আমরা শুধু এক আল্লাহর ইবাদাত করবো, তার সাথে অন্য কিছু শরীক করবো না এবং আমাদের একজন আর একজনকে খোদার আসনে বসাবো না।”

 

হযরত হাতিব ইবন আবী বালতা’য়া মিসরে মাকুকাসের দরবারে উপস্থিত হয়ে তার হাতে রাসুলুল্লাহর সা: উপরোক্ত পত্রটি পৌঁছে দেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে নিম্নোক্ত আলোচনা হয়:

হাতিব: আপনার পূর্বে এখানে এমন একজন শাসক অতীত হয়েছেন যিনি নিজেকে খোদা মনে করতেন। আল্লাহ পাক তাঁকে দুনিয়া ও আখেরাতের আযাবে নিমজ্জিত করে দৃষ্টান্তমূলক প্রতিশোধ গ্রহণ করেছেন। অন্যদের থেকে আপনারও উপদেশ হাসিল করা উচিত। আপনি নিজেই উপদেশ লাভের স্থলে পরিণত হন, এমনটি বাঞ্ছনীয় নয়।

মাকুকাস: আমরা এক ধর্মের অনুসারী। যতদিন অন্য কোন ধর্ম সে ধর্ম থেকে উন্নততর প্রমাণিত না হয় ততদিন আমরা তা পরিত্যাগ করতে পারিনে।

হাতিব: আমরা আপনাকে দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি- যা অন্য সকল দ্বীন থেকে উত্তম ও পরিপূর্ণ। এই নবী যখন মানুষকে এ দ্বীনের দাওয়াত দিলেন, কুরাইশরা তখন তীব্র বিরোধিতা করলো। তাছাড়া ইহুদীরা সর্বাধিক বৈরী ভাব প্রকাশ করে। তবে তুলনামুলকভাবে খৃস্ট ধর্মাবলম্বীরা নমনীয় ছিল।

 

আল্লাহর কসম! মূসা আ: যেমন ঈসার আ: সুসংবাদ দিয়েছিলেন তেমনি ঈসা আ: ও মুহাম্মাদ সা: এর সুসংবাদ দিয়ে গেছেন। আপনার যেমন ইনজীলের দিকে ইহুদিদেরকে আহবান জানান আমরাও তেমনি আপনাদেরকে কুরআনের দাওয়াত দেই।

নবীদের আভির্বাবকালীন সময়ে পৃথিবীতে যত কাওম বা জাতি থাকে তারা সকলে সেই নবীর উম্মাত এবং তাদের ওপর সেই নবীর আনুগত্য ফরয। যেহেতু আপনি একজন নবীর যুগ লাভ করেছেন, তাই তাঁর ওপর ঈমান আনা আপনার অবশ্য কর্তব্য। আমরা আপনাকে দ্বীনে মসীহ থেকে অন্য দিকে ফিরিয়ে নিচ্ছিনা, বরং সঠিকভাবে সেদিকেই নিয়ে যেতে চাচ্ছি।

 

মাকুকাস: মুহাম্মাদ কি সত্যিই একজন নবী?

হাতিব: কেন সত্য নয়?

মাকুকাস: কুরাইশরা যখন তাঁকে নিজ শহর থেকে তাড়িয়ে দিল, তিনি তাদের জন্য বদ-দু’আ করলেন না কেন?

হাতিব: আপনারা কি বিশ্বাস করেন ঈসা আ: আল্লাহর রাসূল? যদি তাই হয়, তাহলে যখন তাঁকে শূলীতে চড়ানো হয়, তাঁর কাওমের লোকদের জন্য বদ দুআ করলেন না কেন?

 

এমন অন্তরভেদী তাতক্ষণিক জবাবে অবলীলাক্রমে মাকুকাসের মুখ থেকে প্রশংসাসূচক ধ্বনি উচ্চারিত হলো। তিনি আরো বললেন, নিশ্চয়ই আপনি একজন মহজ্ঞানী এবং একজন মহাজ্ঞানীর পক্ষ থেকেই এসেছেন। (উসুদুল গাবা-১/৩৬১)। “আমি যতটুকু ভেবে দেখেছি, এই নবী কোন অনর্থক কাজের আদেশ দেন না এবং কোন পছন্দনীয় বিষয় থেকেও বিরত রাখেন না।

 

আমি না তাঁকে ভ্রান্ত যাদুকর বলতে পারি, আর না মিথ্যুক ভবিষ্যদ্বক্তা। তাঁর মধ্যে নবুওয়াতের অনেক নির্দশন বিদ্যামান আমি শিগগিরই বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখবো।” কথাগুলি বলে তিনি হযরত রাসূলে কারীমের সা: পবিত্র পত্রখানি উঠিয়ে হাতির দাঁতের একটি বাক্সে বন্দী করেন এবং সীলযুক্ত করে উপস্থিত এক দাসীর হিফাজতে দিয়ে দেন।

মাকুকাস অত্যন্ত সম্মানের সাথে হযরত হাতিবকে বিদায় দেন এবং তাঁর কাছে রাসুলুল্লাহর জন্য তিনজন দাসী, দুলদুল নামের একটি খচ্চর এবং বেশ কিছু কাপড়সহ মূল্যবান উপহার পাঠান। (যাদুল মাআদ-২৫৭)। মাকুকাস প্রেরিত দাসীত্রয়ের একজন হযরত মারিয়া কিবতিয়া, হযরত রাসূলে কারীম সা: তাঁকে নিজের জন্য রাখেন এবং তাঁরই গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন রাসুলুল্লাহর সা: পুত্র হযরত ইবরাহীম।

 

দ্বিতীয় দাসীটি হযরত মারিয়ার বোন সীরীন। রাসুলুল্লাহ সা: তাঁকে দান করেন প্রখ্যাত কবি হাসসান বিন সাবিত রা: কে তাঁর গর্ভেই জন্মগ্রহণ করে হযরত আবদুর রহমান ইবন হাসসান। তৃতীয় দাসীটিকে রাসুলুল্লাহ সা: দান করেন আবু জাহম ইবন হুজাইফা আল আদাবীকে। (হায়াতুস সাহাবা-১/১৪০-৪১, উসুদুল গাবা-১/৩৬২)।

হিজরী ৮ম সনে মক্কা বিজয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়। বিষয়টি যাতে প্রতিপক্ষ মক্কার কুরাইশরা জানতে না পারে সেজন্য রাসুলুল্লাহ সা: সকলকে সতর্ক করে দেন। হযরত হাতিব মক্কায় বসবাস না করলেও কুরাইশদের সাথে পুরাতন বন্ধুত্বের কারণে তাদের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েন।

 

তিনি মদীনাবাসীদের এই গোপন প্রস্তুতির খবরসম্বলিত একটি পত্রসহ মুযাইনা গোত্রের এক মহিলাকে মক্কার দিকে পাঠান। এর বিনিময়ে মহিলাটিকে তিনি নির্ধারিত মজুরী দেবেন বলে চুক্তি হয়। পত্রখানি মাথার চুলের বেণীর মধ্যে লুকিয়ে মহিলাটি মক্কার দিকে যাত্রা করে। এদিকে ওহীর মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ সা: সব খবর অবগত হলেন। সাথে সাথে তিনি মহিলাটির পিছু ধাওয়া করে পত্রটি উদ্ধারের জন্য আলী, যুবাইর ও মিকদাদকে নির্দেশ দিলেন।

তাঁরা তিনজন খুব দ্রুত সাওয়ারী দাবড়িয়ে “খালীকা” মতান্তরে “রাওদাতু খাক” নামক স্থানে মহিলাকে ধরে ফেলেন। প্রথমে তাঁরা তার বাহনে সন্ধান করে কিছুই পেলেন না। তারপর হযরত আলী রা: মহিলাকে বললেন, “আমি আল্লাহর নামে কসম করে বলছি, রাসুলুল্লাহ সা:কে মিথ্যা খবর দেওয়া হয়নি এবং আমাদেরকেও মিথ্যা বলা হয়নি। হয় তুমি নিজেই পত্রটি বের করে দাও, নয়তো আমরা তোমাকে উলংগ করে তালাশ করবো।” তাঁদের এ কঠোরতা দেখে মহিলা বললো, তোমরা একটু সরে যাও।

 

তারা সরে দাড়ালেন। সে তার মাথার বেণী খুলে তার মধ্য থেকে পত্রটি বের করে দিল। তারা তিনজন পত্রটি নিয়ে রাসুলুল্লাহ সা: এর খিদমতে ‍হাজির হলেন। পত্রটি পাঠ করে রাসুলুল্লাহ সা: বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করেন, ওহে হাতিব তুমি এমন কাজ করলে কেন? হাতিব বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমার ব্যাপারে তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নেবেন না।

যদিও আমি কুরাইশ বংশের কেউ নই, তবুও জাহিলী যুগে তাদের সাথে আমার গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যেহেতু মুহাজিরদের সকলে তাদের মক্কাস্থ আত্মীয় বন্ধুদের সাহায্য সহায়তা করে থাকেন, এজন্য আমার ইচ্ছে হলো, আমার আত্মীয় স্বজনদের সাথে কুরাইশরা যে সদ্ব্যবহার করে থাকে তার কিছু প্রতিদান কমপক্ষে আমি তাদের দান করি। এ কাজ আমি মুরতাদ হয়ে বা ইসলাম ত্যাগ করে অথবা কুফরকে ইসলামের ওপর প্রাধান্য দেওয়ার কারণে করিনি। (সহীহুল বুখারী, কিতাবুল মাগাযী)।

 

অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, হাতিব বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার পরিবার পরিজন তাদের মধ্যে রয়েছে। আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্য ক্ষতিকর হবে না-এমনটি মনে করেই আমি চিঠিটি লিখেছি। ইসলাম গ্রহণের পর থেকে আল্লাহ সম্পর্কে আমার মনে কোন সন্দেহ দেখা দেয়নি। কিন্তু মক্কায় আমি ছিলাম একজন বহিরাগত এবং সেখানে আমার মা, ভাই ও ছেলেরা রয়েছে। (আল ইসাবা-১/৩০০) হায়াতুস সাহাবা-২/৪২৫)।

হাতিবের বক্তব্য শুনার পর হযরত রাসূলে কারীম সা: উপস্থিত সাহাবাদের লক্ষ্য করে বললেন, সে সত্য কথাটি প্রকাশ করে দিয়েছে। এ কারণে কেউ যেন তাকে গালমন্দ না করে। হযরত উমার রা: আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! সে আল্লাহ, রাসূল ও মুসলমানদের প্রতি আস্থাহীনতার কাজ করেছে।

 

অনুমতি দিন, আমি এ মুনাফিকের গর্দান উড়িয়ে দেই। রাসুলুল্লাহ সা: বললেন, সে কি বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি? আল্লাহ বদরের যোদ্ধাদের অনুমতি দিয়েছেন, তোমরা যা খুশি কর জান্নাত তোমাদের জন্য অবধারিত। রহমাতুল লিল আলামীন দয়ার নবীর এ অপূর্ব উদারতায় উমারের দু চোখ সজল হয়ে ওঠে। (সহীহুল বুখারী, ফদলু মান শাহেদা বদরান)।

এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই পবিত্র কুরআনের এ আয়াত নাযিল হয়,

“ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, আমার শত্রু ও তোমাদের শত্রুকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তোমরা তাদের সাথে বন্ধুত্বের আচরণ কর, অথচ তোমাদের নিকট যে সত্য এসেছে তা তারা অস্বীকার করেছে। (সূরা মুমতাহিনা-১)।

হযরত রাসূলে কারীমের সা: ওফাতের পর প্রথম খলীফা হযরত আবু বাকার রা: তাঁকে দ্বিতীয়বার মাকুকাসের দরবারে পাঠান এবং মাকুকাসের সাথে একটি সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করেন। হযরত আমর ইবনুল আসের রা: মিসর জয়ের পূর্ব পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে এ চুক্তি বহাল থাকে। (আল ইসতিয়াব)।

হিজরী ৩০ সনে ৬৫ বছর বয়সে তিনি মদীনায় ইনতিকাল করেন। হযরত উসমান রা: জানাযার নামাযের ইমামতি করেন এবং বিপুল সংখ্যক লোকের উপস্থিতিতে তাঁর দাফন কাজ সম্পন্ন হয়। (আল ইসতিয়াব)।

 

প্রতিশ্রুতি পালন, উপকারের প্রতিদান দেওয়া এবং ষ্পষ্ট ভাষণ তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আত্মীয় বন্ধুদের প্রতি ছিল তাঁর সীমাহীন দরদ। মক্কা বিজয়ের পূর্বে তিনি যে পত্রটি লেখেন তা ছিল মূলত: এ দরদের তাকিদেই। আর রাসূল সা: তা উপলদ্ধি করেই তাঁকে ক্ষমা করে দেন। তাঁর স্বভাব ছিল কিছুটা রুক্ষ। দাসদের সাথে কঠোর আচরণ করতেন।

এ কারণে রাসুল সা: ও পরবর্তী খলীফারা মাঝে মাঝে তাঁকে বকাঝকা করে সংশোধন করতেন। একবার তাঁর এক দাস হযরত রাসূলে কারীমের সা: খিদমতে হাজির হয়ে তাঁর কঠোরতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বললো, ইয়া রাসুলাল্লাহ, নিশ্চয়ই হাতিব জাহান্নামে যাবে। রাসূল ‍সা: বললেন, তুমি মিথ্যা বলছো। যে ব্যক্তি বদর ও হুদাইবিয়ায় অংশ নিয়েছে সে জাহান্নামে যেতে পারে না। (ইসতিয়াব)।

হযরত উমার রা:-র খিলাফতকালে বহুবার তাঁর দাসেরা তাঁর বিরুদ্ধে খলীফার নিকট কঠোরতার অভিযোগ এনেছে। একবার তাঁর এক দাস মুযাইনা গোত্রের এক ব্যক্তির একটি উট জবেহ করে দেয়, তার শাস্তি স্বরূপ তিনি সেই দাসের জন্য কঠোর শাস্তি নির্ধারণ করেন। খলীফা জানতে পেয়ে তাঁকে ডেকে বলেন, জানতে পেলাম, তুমি তোমার দাসদের অনাহারে রাখ। খলীফা তাকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দেন।

ব্যবসা ছিল তার জীবিকার প্রধান উতস। খাবারের একটি দোকান থেকে তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। মৃত্যুকালে চার হাজার দীনার এবং অনেকগুলি বাড়ী রেখে যান। কেউ বলেছেন, হাতিব থেকে রাসুলুল্লাহর সা: তিনটি হাদীস, আবার কেউ বলেছেন, দুটি হাদিস বর্ণিত আছে।

উতবা ইবন গাযওয়ান (রা:)

নাম উতবা, ডাক নাম আবু আবদিল্লাহ। পিতা গাযওয়ান ইবন জাবির। ‍জাহিলী যুগে তার গোত্র বনী নাওফাল ইবন আবদে মান্নাফের সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিল। ইসলামের সূচনালগ্নে তাওহীদের আহবানে সাড়া দানকারীদের মধ্যে উতবা অন্য ব্যক্তি। একবার এক ভাষণে তিনি দাবী করেন, তিনি সপ্তম মুসলমান। (উসুদুল গাবা-৩)

মক্কায় কাফিরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে হাবশার দ্বিতীয় হিজরাতে শরিক হন। তখন তার বয়স ৪০ বছর। কিছুদিন হাবশায় থাকার পর আবার মক্কায় ফিরে এসে বসবাস করতে থাকেন। হযরত রাসূলে করীম সা: তখনও মক্কায়। (আল ইসতিসাব, উসুদুল গাবা-৩/৩৬৪)।

রাসুলুল্লাহ সা: যখন মদীনায় হিজরাত করেন এবং কুফর ও ইসলামের মধ্যে সামরিক সংঘাত শুরু হলো, তিনি এবং মিকদাদ একটি কুরাইশ বাহিনীর সাথে মদীনার দিকে যাত্রা করেন। ইকরামা ইবন আবী জাহল ছিল এই বাহিনীর নেতা। পথে মদীনার মুসলিম মুজাহিদদের একটি ক্ষুদ্র দলের সাথে এই বাহিনীর ছোট-খাট একটি সংঘর্ষ হয়।

এই মুজাহিদ দলটির নেতা ছিলেন হযরত উবাইদা ইবনুল হারিস। উতবা এবং মিকদাদ সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তারা সুযোগমত মুজাহিদ দলটির ‍সাথে যোগ দেন। মদীনায় পৌঁছে উতবা হযরত আবদুল্লাহ ইবন সালামা আজলানীর অথিতি হন এবং হযরত আবু দুজানা আনসারীর সাথে তার ভাতৃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। (তাবাকাতে ইবন সা’দ-৩/৬৯)।

হযরত উতবা ইবন গাযওয়ান ছিলেন একজন দক্ষ তীরন্দায। বদর, উহুদ, খন্দক ছাড়াও যে সকল যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ সা: প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন তার সবগুলোতো তিনি অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা পালন করেন। আবদুল্রাহ ইবন জাহাশের নেতৃত্বে রাসুলুল্লাহ সা: যে অনুসন্ধানী দলটি নাখলার দিকে পাঠান, তিনি সে দলেরও সদস্য ছিলেন। (হায়াতুস সাহাবা-২/৩৫০)।

হিজরী ১৪ সনে দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমার রা: ইরাকের সামুদ্রিক বন্দর উবুল্লা, মায়সান ও তার আশ পাশের এলাকায় অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পণ করে একটি বাহিনীসহ মদীনা থেকে পাঠান। ঘটনাটি বিভিন্ন গ্রন্থে এভাবে বর্ণিত হয়েছে: “আমীরুল মুমিনীন হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব রা: ইশার নামাযের পর একটু বিশ্রামের জন্য বিছানায় গেলেন, যাতে একটু পরে রাতে নগর ভ্রমণে বের হতে পারেন। কিন্তু তাঁর দুচোখে ঘুম নেই। দূ

ত খবর নিয়ে এসেছে, পরাজিত পারস্য বাহিনী পাল্টা আক্রমণের জন্য বিক্ষিপ্ত অবস্থা থেকে সুসংগঠিত হয়েছে। খলীফাকে আরো জানানো হয়েছে, বসরার নিকটবর্তী ‘উবুল্লা’ নগরী পরাজিত পারস্য বাহিনীর অর্থ ও লোক সরবরাহের প্রধান উতস। খলীফা পারস্য বাহিনীর এই উতস বন্ধ করার জন্য ‘উবুল্লায়’ অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

কিন্তু অপর্যাপ্ত সামরিক শক্তি তার এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাড়ালো। কারণ, মদীনায় তখন অল্প কিছু লোক ছাড়া প্রায় সকলে বিভিন্ন ফ্রন্টে অভিযানে লিপ্ত। খলীফা উমার রা: তখন তাঁর চিরাচরিত পদ্ধতি কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন। আর তা হলো, সৈন্যের স্বল্পতা শক্তিশালী ও যোগ্য নেতৃত্বের দূরীকরণ।

তিনি সেনা কমান্ডারদের সম্পর্কে ভাবলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি আপন মনে বলে উঠলেন: পেয়েছি। হাঁ আমি পেয়েছি। তারপর এ কথা বলতে বলতে তিনি বিছানায় গেলেন, তিনি সেই মুজাহিদ যাকে বদর, উহুদ ও খন্দকের মত যুদ্ধ সমূহ চিনেছে। ইয়ামামাও তার যোগ্যতা ও ভূমিকার সাক্ষী। কোন যুদ্ধেই তার তরবারী ভোতা হয়নি, তার একটি তীরও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। তদুপরি তিনি দুইটি হিজরাতের অধিকারী, ধরাপৃষ্টে তিনি সপ্তম মুসলমান।

সকাল বেলা তিনি বললেন: তোমরা কেউ উতবা ইবন গাযওয়ানকে ডেকে দাও। খলীফা তাঁকে তিনশোর কিছু বেশি সদস্য বিশিষ্ট একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দান করেন এবং পশ্চাতগামী আরো কিছু সৈন্য দিয়ে সাহায্য করার অঙ্গীকারও করেন।

মদীনা থেকে উতবা তার বাহিনীসহ রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে খলীফা উমার বাহিনী প্রধান উতবাকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন:

“আল্রাহর রহমত ও বরকতের ওপর নির্ভর করে আরবের শেষ সীমা ও অনারব সাম্রাজ্যের নিকটবর্তী অংশের দিকে আপনার সঙ্গীদের নিয়ে আপনি রওয়ানা হয়ে যান। যতদূর সম্ভব তাকওয়া অবলম্বন করবেন এবং স্মরণ রাখবেন, আপনারা শত্রু ভূমিতে যাচ্ছেন। আমি আশা করি আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করবেন।

আমি আলা ইবনুল হাদরামীকে লিখেছি, আরফাজা ইবন হারসামাকে পাঠিয়ে আপনাকে সাহায্য করার জন্য। শত্রুর মোকাবেলায় তিনি এক করিৎকর্মা মুজাহিদ। তিনি আপনার উপদেষ্ঠা হিসেবে থাকবেন। অনারবদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান জানাবেন। যারা সে আহবান মেনে নেবে, তাদেরকে নিরাপত্তা দেবেন।

আর যারা তা অস্বীকার করবে, জিযিয়া দিয়ে শাসিত জীবন যাপনে বাধ্য করবেন। অন্যথায় তলোয়ারের সাহায্যে ফায়সালা করবেন। চলার পথে যে সকল আরব গোত্রের পাশ দিয়ে যাবেন ‍তাদেরকে শত্রুর সাথে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করবেন এবং সর্ব অবস্থায় আল্লাহকে ভয় করবেন। (উসুদুল গাবা-৩/৩৬৪)।

উতবা ইবন গাযওয়ান তার বাহিনী নিয়ে রওয়ানা দিলেন। সেই বাহিনীর সাথে তার স্ত্রী সহ অন্য সৈনিকদের আরো পনেরো জন মহিলাও চললেন। তারা ‘উবুল্লা’ শহরের অদূরে ‘কাসবা’ নামক এক প্রকার জলজ উদ্ভিদ বিশিষ্ট ভূমিতে পৌঁছলেন। তাদের কাছে তখন খেয়ে বেঁচে থাকার মত কোন কিছু নেই। যখন তারা মারাত্মক ক্ষুধার সম্মুখীন হলেন, উতবা তাঁর বাহিনীর কতিপয় সদস্যকে খাওয়ার কোন কিছু তালাশ করার নির্দেশ দিলেন। তাঁদের এই খাদ্য তালাশের সাথে একটি চমকপ্রদ কাহিনী জড়িত আছে। তাদেরই একজন বর্ণনা করছেন:

“আমরা খাদ্যের সন্ধানে ঘন জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। সেখানে দুটো বস্তা পড়ে থাকতে দেখলাম। তার একটিতে খেজুর ভর্তি এবং অন্যটিতে এক প্রকার সাদা শস্যদানা যার উপরিভাগ সোনালী আবরণে আবৃত। আমরা বস্তা দুটো টেনে আমাদের সেনা ছাউনীর কাছাকাছি নিয়ে এলাম।

আমাদের একজন শস্যদানা ভরা বস্তাটির দিকে ‍তাকিয়ে বললো, “এটা বিষ, শত্রুরা রেখে দিয়েছে। কেউ এর ধারে কাছে যাবে না।” আমরা খেজুর খেতে লাগলাম। এর মধ্যে আমাদের ঘোড়া ছুটে গিয়ে শস্যদানার বস্তায় মুখ দিয়ে খেতে শুরু করলো। আমরা তো প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, ঘোড়াটি মারা যাবার পূর্বেই জবেহ করে দেওয়ার, যাতে তার গোশত আমরা খেতে পারি।

অত:পর ঘোড়ার মালিক আমাদের বললো: একটু অপেক্ষা করা যাক, আজ রাত আমরা ঘোড়াটি পাহারা দেই। যদি দেখা যায়, সত্যি সত্যিই ঘোড়াটি ‍মারা যাচ্ছে তাহলে জবেহ করা যাবে। কিন্তু সকালে দেখা গেল ঘোড়াটি সম্পূর্ণ সুস্থ। তখন আমার বোন আমাকে বললো: ভাই আমার আব্বাকে বলতে শুনেছি, বিষ আগুনে জ্বালিয়ে সিদ্ধ করা হলে তার ক্রিয়া নষ্ট হয়ে যায়।

তারপর সে কিছু শস্যদানা নিয়ে হাঁড়িতে ফেলে সিদ্ধ করা শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর সে আমাদের ডেকে বলল, দেখুন, কেমন লাল হয়ে গেছে। সে দানাগুলির খোসা ছড়িয়ে সাদা দানা বের করলো। আমরা সেগুলি একটি পাত্রে রাখলাম। উতবা বললেন: তোমরা বিসমিল্লাহ বলে খেয়ে ফেল। আমরা খেয়ে দেখলাম চমৎকার স্বাদ। পরে আমরা জেনেছিলাম এই শস্যদানার নাম “ধান”।

এই ‘উবুল্লা’ ছিল দিজলার তীরে, শত্রু বাহিনীর একটি সুদৃঢ় ঘাঁটি। উতবা মাত্র ছয়’শ যোদ্ধা ও কতিপয় মহিলাকে সাথে নিয়ে এ ঘাঁটি জয় করেন। তাদের অস্ত্র শস্ত্রও ছিল অতি মামুলী ধরণের। যথা: তীর, তরবারি, বর্শা ইত্যাদি। কিন্তু তিনি মেধা, বুদ্ধিমত্ত ও সাহসিকতার সাহায্যে এ অসাধ্য সাধন করেন।

উতবা মহিলাদের জন্য অনেকগুলি পতাকা বানিয়ে বর্শার মাথায় বেঁধে দেন। তাদেরকে নির্দেশ দেন, তারা যেন মুসলিম মুজাহিদদের পেছনে সেগুলি উঁচু করে ধরে রাখে। তিনি তাদের আরো বলেন, আমরা যখন ‘উবুল্লা’ শহরের কাছাকাছি পৌঁছে যাব তখন তোমরা খুব বেশি করে ধুলো উড়াবে, যাতে চারিদিক ধূলোয় অন্ধকার হয়ে যায়।

মুসলিম বাহিনী যখন উবুল্লার নিকটবর্তী হলো, পারস্য বাহিনী শহর থেকে বেরিয়ে এসে দিগন্তব্যাপী ধূলোর মেঘ ও অসংখ্য পতাকার ওঠানামা দেখতে পেল। তারা পরষ্পর বলাবলি করল: এতো অগ্রবর্তী বাহিনী। এদের পেছনে অসংখ্য সৈন্য রয়েছে, তারাই এ ধূলো উড়াচ্ছে। তাদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার হলো, আতঙ্কে তারা অস্থির হয়ে পড়লো।

তারা হাতের কাছে যা পেল তাই নিয়ে দিজলা নদীতে নোঙ্গর করা নৌকায় উঠে পালিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে গেল। উতবা তার বাহিনীর একজন সদস্যকেও না হারিয়ে উবুল্লায় প্রবেশ করেন। অত:পর দিজলা উপকূলবর্তী নগর ও গ্রামসমূহ পদানত করে ইসলামী ঝান্ডা সমুন্নত করেন।

উবুল্লায় মুসলিম বাহিনী অগণিত গণিমত লাভ করে। মুসলিম বাহিনীর এক সৈনিক মদীনায় এলে মদীনাবাসীরা তাকে প্রশ্ন করে উবুল্লায় মুসলমানরা কেমন আছে? তিনি বলেন, তোমরা কোন বিষয়ে জিজ্ঞেস করছো? আল্লাহর কসম, আমি যখন তাদেরকে রেখে এসেছি তখন তারা সোনা রূপা পাল্লায় করে ওজন দিচ্ছে।” এ কথা শুনে মদীনাবাসীরা উবুল্লার দিকে সওয়ারী হাঁকালো।

উবুল্লা জয়ের পর হযরত উতবা ভেবে দেখলেন, যদি তাঁর সৈন্যরা এই বিজাতীয় ভূমিতে শহরের স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে সহ অবস্থান করে তাহলে খুব তাড়াতাড়ি বিজাতীয় আচার আচরণে অভ্যস্ত হয়ে তাদের স্বকীয়তা ‍হারিয়ে ফেলবে। বিষয়টি তিনি খলীফা উমার রা: কে জানান এবং বসরা নামক স্থানে একটি সামরিক শহর নির্মাণের অনুমতি প্রার্থনা করেন।

এই বসরা ছিল উবুল্লা বন্দরের নিকটবর্তী একটি স্থান যেখানে পারস্য ‍উপসাগরে চলাচলরত ভারতবর্ষ ও পারস্যের জাহাজসমূহ নোঙ্গর করতো। হযরত উতবা রা: আটশো লোক সঙ্গে করে সর্ব প্রথম উক্ত স্থানে যান এবং বসরা নগরীর ভিত্তি স্থাপন করেন। প্রত্যেক গোত্রের জন্য তিনি পৃথক মহল্লা নির্ধারণ করে দেন।

জামে মসজিদ নির্মাণের দায়িত্ব অর্পণ করেন হযরত মিহজান ইবনুল আদরা এর ওপর। নগরীর বাড়ী ঘর প্রথমত: গাছ পাথর দিয়ে তৈরী হয়। এ কারণে জামে মসজিদও গাছপালা দিয়ে নির্মিত হয়। তবে তিনি নিজের জন্য কোন প্রাসাদ নির্মাণ করেননি। কাপড়ের তৈরী তাঁবুতে তিনি বসবাস করতেন। (উসুদুল গাবা-৩/৩৬৪)।

হযরত উতবা রা: এই নতুন শহরের প্রথম শাসক নিযুক্ত হন এবং ছয় মাস যাবত অত্যন্ত দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু পার্থিব সুখ-সম্পদের প্রতি তাঁর যুহদ ও নির্মোহ স্বভাব তাঁকে পদ থেকে সরে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে। তাছাড়া তিনি বসরার মুসলমানদের বিলাসী জীবন যাবন লক্ষ্য করে আঁতকে ওঠেন।

যারা কিছুদিন পূর্বেও সিদ্ধ ধানের চেয়ে উত্তম খাবার চিনতো না, এখন তারা পারস্যের অভিজাত খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তিনি দ্বীনের ব্যাপারে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এই সময় তিনি মসজিদে সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তার কিয়দাংশ নিম্নরূপ:

“বন্ধুগণ! দুনিয়া গতিশীল ও বিলীয়মান। তার বেশী অংশ অতিক্রান্ত হয়েছে। তোমরা নিশ্চিতভাবে এই দুনিয়া থেকে এমন এক স্থানে স্থানান্তরিত হবে যার কোন ধ্বংস নেই। তাহলে সর্বোত্তম পাথেয় সংগে নিয়ে যাচ্ছ না কেন? আমাকে বলা হয়েছে, যদি কোন প্রস্তর খন্ড জাহান্নামের কিনারা থেকে নিক্ষেপ করা হয় তাহলে সত্তর বছরেও তার তলদেশে পৌঁছতে পারবে না।

কিন্তু আল্লাহর কসম! তোমরা তা পূর্ণ করে ফেলবে। কি, তোমরা অবাক হচ্ছো? আল্লাহর কসম আমাকে বলা হয়েছে, জান্নাতের দরযা এত প্রশস্ত হবে যে, সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে চল্লিশ বছর লাগবে। কিন্তু এমন একদিন আসবে যখন সেখানে প্রচণ্ড ভীড় জমে যাবে। আমি যখন ঈমান আনি তখন রাসুলুল্লাহ সা: সঙ্গে মাত্র ছয় ব্যক্তি।

অভাব ও দারিদ্র্যের এমন চরম অবস্থা ছিল যে, গাছের পাতাই ছিল আমাদের জীবন ধারণের প্রধান অবলম্বন। সেই পাতা খেতে খেতে আমাদের ঠোঁটে ঘা হয়ে যেত। একদিন আমি একটি চাদর কুঁড়িয়ে পাই। সেটা ফেঁড়ে আমি ও সা’দ ইবন আবী ওয়াক্কাস পরনের তহবন্দ বানিয়ে নেই।

কিন্তু আজ এমন দিন এসেছে যখন আমাদের প্রত্যেকেই কোন না কোন শহরের আমীর হয়েছে। আল্লাহর কাছে নিকৃষ্ট হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে বড় মনে করি-এমন অবস্থা থেকে আল্লাহর পানাহ চাই। নবুওয়াত শেষ হয়েছে। অবশেষে রাজতন্ত্র কায়েম হবে এবং খুব শিগগিরই তোমরা অন্যান্য আমীরদের পরীক্ষা করবে। (মুসনাদে আহমাদ ইবন হাম্বল-৪/১৭৪)।

অত:পর হযরত উতবা রা: হযরত মাজাশি ইবন মাসউদকে ফুরাতের তীরবর্তী অঞ্চল সমূহে সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেন এবং হযরত মুগীরা ইবন শু’বাকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ যান। সেখানে আমীরুল মুমিনীন হযরত উমার রা: ও উপস্থিত ছিলেন।

সেখানে তিনি খলীফার নিকট দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চান; কিন্তু খলীফা তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বারবার আবেদন করেন, আর খলীফাও বারবার তা প্রত্যাখ্যান করেন। খলীফা তাঁকে বসরায় ফিরে গিয়ে পুনরায় দায়িত্ব গ্রহণের নির্দেশ দেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি খলীফার নির্দেশ মেনে নেন।

মক্কা থেকে বসরা অভিমুখে যাত্রাকালে উটের পিঠে আরোহনের পূর্ব মুহুর্তে অত্যন্ত বিনীতভাবে তিনি দুআ করেন- আল্লাহুম্মা লা তারুদ্দানী ইলাইহা, আল্লাহুম্মা লা তারুদ্দানী ইলাইহা- ওহে আল্লাহ, তুমি আমাকে বসরায় ফিরিয়ে নিওনা, হে আল্লাহ তুমি আমাকে সেখানে ফিরিয়ে নিওনা।

আল্লাহ পাক তাঁর দুআ কবুল করেন। পথিমধ্যে হঠাৎ উটের পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে মা’দানে সালীম নামক স্থানে পঁচাত্তর বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু সন হিজরী ১৭ মতান্তরে ২০। সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য সুনান গ্রন্থসমূহে উতবা ইবন গাযওয়ান থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে।

আমের ইবন ফুহাইরা (রা:)

নাম আমের, ডাক নাম আবু আমর। পিতা ফুহাইরা, মতান্তরে ফুহাইরা তাঁর মাতার নাম। ইবন হিশাম বলেন, ‘আমের ইবন ফুহাইরা বনী আসাদের এক অনারব নিগ্রো দাস। হযরত আবু বকর সিদ্দীক তাঁকে খরীদ করে আযাদ করে দেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/২৫৯)। অন্য একটি বর্ণনা মতে, আমের ছিলেন হযরত আয়িশার বৈপিত্রীয় ভাই ইযদ গোত্রের তুফাইল ইবন আবদিল্লাহর দাস।

হযরত সিদ্দীকে আকবর রা: হিজরাতের পূর্বে যাদের দাসত্ব থেকে মুক্ত করেন ‘আমের ইবন ফুহাইরা তাদের মধ্যে সপ্তম ব্যক্তি। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৩১৮)। হযরত রাসূলে কারীম সা: মক্কায় হযরত আরকামের গৃহে আশ্রয় গ্রহণের পূর্বেই ইসলামের সেই সূচনালগ্নে ‘আমের ইবন ফুহাইরা তাওহীদের দাওয়াত কবুল করেন।

একে তো অসহায় দাস, তার ওপর ইসলাম গ্রহণ, ফলে মুসীবতের পাহাড় তাঁর ওপর নেমে আসে। নির্যাতনের নানা রকম কৌশল তার ওপর প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু তিনি সকল অত্যাচারের মুখেও পাহাড়ের মত অটল থাকেন। অবশেষ হযরত সিদ্দীকে আকবরের (রা:) বদন্যতায় তিনি দাসত্বের জিঞ্জির থেকে মুক্তি পান। (উসুদুল গাবা-৩/১৯১)। হযরত রাসূলে কারীম সা: যখন আবু বকর সিদ্দিককে রা: সংগে করে মক্কা থেকে মদীনার উদ্দেশ্যে বের হয়ে ‘সাওর’ পর্বতের গুহায় আত্মগোপন করেন, তখন ‘আমের ইবন ফুহাইরা সারাদিন ‘সাওর’ পর্বতের আশেপাশের চারণক্ষেত্রে আবু বকরের রা: বকরী চরাতেন এবং যেখানে রাসুলুল্লাহ সা: ও আবু বকর দুধ খাইয়ে তাঁদের পানের ব্যবস্থা করতেন।

আর এদিকে হযরত আবু বকরের পুত্র আবদুল্লাহ প্রতিদিন রাতে গোপনে সাওর পর্বতের গুহায় আসতেন রাসুলুল্লাহ সা: ও সিদ্দীকে আকবরকে মক্কার অবস্থা জানাতে। সকালে তিনি যখন বাড়ীতে ফিরতেন ‘আমের বকরীর পাল নিয়ে তার পিছে পিছে চলতেন, তার পায়ের নিশানা মুছে যায় এবং কারো মনে কোন রকম সন্দেহ না দেখা দেয়। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৪৮৬, বুখারী- কিতাবুল মাগাযী)।

অত:পর রাসুলুল্লাহ সা: ও আবু বকর রা: সাওর পর্বতের গুহা থেকে বেরিয়ে মদীনার দিকে যাত্রা করেন এং আবু বকর রা: স্বীয় বাহনের পেছনে আমেরকে উঠিয়ে নেন। এভাবে আমের মদীনায় হিজরাত করেন। মদীনা তিনি হযরত সা’দ ইবন খুসাইমার রা: অতিথি হন এবং হযরত হারিস ইবন আউসের ‍সাথে তার মুওয়াখাত বা দ্বীনী ভাতৃ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। (তাবাকাতে ইবন সা’দ-৩/১৬৪)।

মক্কা থেকে মদীনায় আগত যে সকল লোকের স্বাস্থ্যের জন্য প্রথম প্রথম মদীনার আবহাওয়া উপযোগী হচ্ছিল না আমের তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন হযরত আয়িশা রা: বলেন, রাসুলুল্লাহ সা: মদীনায় হিজরত করলেন, তখন মদীনা আল্লাহর যমীনের মধ্যে সর্বাধিক জ্বরের এলাকা। সেখানে রাসুলুল্লাহর সা: সঙ্গী সাথীরা ব্যাপকভাবে জ্বরে আক্রান্ত হলেন।

আবু বকর রা: তাঁর দুই আযাদকৃত দাস- আমের ইবন ফুহাইরা ও বিলালের সাথে একই ঘরে থাকতেন। তারা সবাই জ্বরে পড়লেন। আমি তাদের দেখতে গেলাম। এটা পর্দার হুকুমের আগের কথা। প্রচণ্ড জ্বরে তখন তাঁদের অচেতন অবস্থা। প্রথমে আবু বকরের কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর আমি আমের ইবন ফুহাইরার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আমের, কেমন অনুভব করছেন? তিনি দুলাইন কবিতা আউড়িয়ে জবাব দিলেন, ‘মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণের পূর্বেই আমি তাকে পেয়েছি, নিশ্চয় কাপুরুষের মৃত্যু ওপর থেকে হঠাত আছে। প্রতিটি মানুষ তার সাধ্য অনুযায়ী বাঁচার চেষ্ঠা করে, যেমন গরু তার শিং দিয়ে চামড়া বাঁচিয়ে থাকে।’

আয়িশা রা: বলেন, ‘আল্লাহর কসম, আমের নিজেই জানে না, সে কী বলছে।’ তারপর হযরত আয়িশা রা: বিলালের কুশলাদি জিজ্ঞেস করে রাসুলুল্লাহ সা: এর নিকট ফিরে যান এবং তাদের অবস্থা রাসুলুল্লাহ সা: কে অবহিত করেন। রাসুলুল্লাহ সা: তখন দুআ করেন, ‘হে আল্লাহ, মদীনাকে তুমি আমাদের নিকট মক্কার মত বা তার চেয়ে বেশি পছন্দনীয় ও প্রিয় বানিয়ে দাও, তার খাদ্য দ্রব্যে আমাদের জন্য বরকত দাও এবং তার রোগ ব্যাধি ‘মাহইয়া’ নামক স্থানে সরিয়ে নাও।’ (সীরাতু ইবন হিশাম-১/৫৮৮-৮৯), সহীহুল বুখারী- বাবু হিজরাতিন নাবী ওয়া আসহাবিহী)।

রাসুলুল্লাহ সা: এর দোআ কবুল হয় এবং তাঁরা সকলে সুস্থ হয়ে ওঠেন। হযরত আমের ইবন ফুহাইরা বদর ও উহুদ যুদ্ধে শরীক ছিলেন। উহুদ যুদ্ধের পর আবু বারা আমের ইবন মালিক নামক এক ব্যক্তি মদীনায় রাসুলুল্লাহর সা: খিদমতে হাজির হয়। হযরত রাসূলে ‍কারীম সা: তার কাছে ইসালামের দাওয়াত পেশ করেন ; কিন্তু সে না করলো কবুল এবং না প্রত্যাখ্যান করলো।

সে বললো, ‘হে মুহাম্মাদ, আপনি যদি আপনার সাথীদের মধ্য থেকে কিছু লোককে নাজদবাসীদের নিকট পাঠাতেন এবং তারা যদি নাজদীদের কাছে আপনার দাওয়াত পেশ করতেন তাহলে আমার বিশ্বাস তারা আপনার দাওয়াত কবূল করতো।’ রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘আমি নাজদীদের পক্ষ থেকে তাদের ওপর আক্রমণের ভয় করছি।’ আবু বারা বললো, ‘তাদের ব্যাপারে আমি জিম্মাদার। আপনি লোক পাঠান এবং ‍তারা আপনার দ্বীনের দাওয়াত দিক। তার কথার উপর আস্থা রেখে হযরত রাসূলে কারীম সা: চল্লিশ মতান্তরে সত্তর জন লোককে বাছাই করে একটি দল গঠন করেন। এই দলের মধ্যে হযরত আমের ইবন ফুহাইরাও ছিলেন।

রাসুলুল্লাহ রাসুলুল্লাহহর সা: নির্দেশে এই দলটি উহুদ যুদ্ধ শেষ হওয়ার চতুর্থ মাসে ৪ হিজরী সনে মদীনা থেকে যাত্রা করে এবং বনী আমের ও হাররা বনী সুলাইমের মধ্যবর্তী ‘বিরে মাউনা’ নামক স্থানে তাঁবু স্থাপন করে। অত:পর তারা হারাম ইবন মিলহানের মাধ্যমে রাসুলুল্লাহর সা: একটি চিঠি আমের ইবন তুফাইলের কাছে পাঠান।

চিঠিটি পাঠ না করেই আমের ইবন তুফাইল দূত হারাম ইবন মিলহানকে হত্যা করে। তারপর বনী সুলাইম, রি’ল ও যাকওয়ানের সহায়তায় দলটির ওপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে একমাত্র কা’ব ইবন যায়িদ মতান্তরে আমর ইবন উমাইয়া দামারী রা: ছাড়া সকলকে হত্যা করে। হযরত কাব মারাত্মক আহত অবস্থায় কোন রকমে বেঁচে যান।

পরে তিনি খন্দক যুদ্ধে শাহাদত বরণ করেন। (সীরাতু ইবন হিশাম-১/১৮৩-৮৬) গাদ্দার জাব্বার ইবন সালমার বর্শা যখন হযরত আমের ইবন ফুহাইরার রা: বক্ষ বিদীর্ণ করে গেল, তখন অবলীলাক্রমে তার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল- ‘ফুযতু ওয়াল্লাহ- আল্লাহর কসম, আমি সফলকাম হয়েছি।’ লাশ লাফিয়ে আসমানের দিকে উঠে গেল। ফিরিশতারা তার দাফন কাফন করে।

তার পবিত্র রুহের জন্য আলা ইল্লীয়্যীনের দরযা উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো। এই অলৌকিক দৃশ্য অবলোকনে ঘাতক জাব্বার ইবন সালমা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ে এবং এত প্রভাবিত হয় যে, সে ইসলাম গ্রহণ করে। বিরে মাউনার এই হৃদয় বিদারক ঘটনার পর হযরত রাসূলে কারীম সা: একাধারে চল্লিশ দিন ফজরের নামাযে ‘কুনুতে নাযিলা’ পাঠ করে এবং এই ঘাতকদের জন্য বদ দুআ করেন।

এই ঘটনার পর আমের ইবন তুফাইল মদীনায় আসে এবং রাসুলুল্লাহকে সা: জিজ্ঞেস করে, হে মুহাম্মাদ, ঐ ব্যক্তি কে যাকে তীরবিদ্ধ করার পরই আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়? রাসুলুল্লাহ সা: বললেন, সে আমের ইবন ফুহাইরা। (টীকা সীরাতু ইবন হিশাম-১/১৮৬, তাবাকাত ইবন সা’দ- মাগাযী)।

হযরত আমের ইবন ফুহাইরার দেহের বাহ্যিক রং ছিল হাবশী নিগ্রোদের মত কালো এবং তাঁর (চৌত্রিশ) বছর জীবনের বেশির ভাগ অত্যাচারী মনিবদের দাসত্ব ও গোলামীতে অতিবাহিত হয়েছে। তবে চারিত্রিক সৌন্দর্যে তিনি ছিলেন মহীয়ান। তিনি বিভিন্ন বিপদ মুসীবতে যে ধৈর্য্য ও দৃঢ়তা দেখিয়েছেন তাতেই তার চারিত্রিক মাধুর্য অতি চমতকার রূপে দীপ্তিমান হয়ে উঠেছে।

তিনি এমন বিশ্বাসী ছিলেন যে, রাসুলুল্লাহ সা: বহু সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে তার ওপর আস্থা রেখেছেন। শাহাদাতের তীব্র আকাঙ্খা তাকে দুনিয়ার প্রতি উদাসীন করে তুলেছিল। তাই বিরে মাউনার সংঘর্ষে যখন তার বুকে বর্শা বিধিয়ে দেওয়া হলো, অবলীলায় তার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল ফুযতু ওয়াল্লাহ-আল্লাহর কসম, আমি সফলকাম হয়েছি।

আবদুল্লাহ ইবন সুহাইল (রা:)

নাম আবদুল্লাহ, ডাক নাম বা কুনিয়াত আবু সুহাইল। পিতা সুহাইল এবং মাতা ফাখতা বিনতু আমের।ইসলামের প্রথম পর্বে ঈমান আনেন এবং হাবশা অভিমূখী দ্বিতীয় কাফিলার সাথে হাবশায় হিজরাত করেন। কিছুদিন হাবশায় অবস্থানের পর মক্কায় ফিরে এলে পিতা তাকে বন্দী করে এবং তার ওপর নির্দয় অত্যাচার চালায়।

আবদুল্লাহ অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ইসলাম ত্যাগ করে পুনরায় মুশরিকী জীবনে বা পৌত্তলিকতায় ফিরে যাওয়ার ভান করেন। মাতা পিতা ও মক্কার মুশরিকরা তার বাহ্যিক আচরণ দেখে ইসলাম পরিত্যাগ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে যায়।

এদিকে হযরত রাসূলে কারীম সা: মক্কা ছেড়ে মদীনায় চলে যান। মক্কা ও মদীনার মাঝে সামরিক সংঘর্ষ শুরু হয়। মক্কাবাসীরা আবদুল্লাহকে তাদের সহযোদ্ধা হিসেবে বদরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য নিয়ে যায়। কিন্তু যে হৃদয়ে একবার ঈমানের নুর প্রবেশ করে সেখানে যে কক্ষনো শিরকের অন্ধকার প্রবেশ করতে পারে না- এ কথাটি তাদের জানা ছিল না। মূলত: আবদুল্লাহ কোনদিন ইসলাম ত্যাগ করেননি। তিনি শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। বদরে মুসলিম বাহিনীতে যোগদান করেন।

 

এক আকস্মিক ঘটনায় আবদুল্লাহর পিতা ক্রোধে ফেটে পড়ে। সে এর প্রতিশোধকল্পে প্রচণ্ড বেগে আক্রমণ চালায়। কিন্তু তাতে কোন লাভ হলোনা। আবদুল্লাহ তখন স্বাধীন, তাঁর দ্বীনী ভাইদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পিতার বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়ছেন। অবশেষ বিজয় হলো মুসলমানদের। বদরের পর সকল প্রসিদ্ধ যুদ্ধেই হযরত আবদুল্লাহ রা: রাসুলুল্লাহ’র সা: সংগে থেকে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। হুদাইবিয়ার সন্ধি ও বাইয়াতে রিদওয়ানেও তিনি শরীক ছিলেন। (আল ইসাবা-২/৩২৩)।

মক্কা বিজয়ের সময়ও হযরত আবদুল্লাহ রা: রাসুলুল্লাহর সা: সফরসঙ্গী ছিলেন। তার পিতা সুহাইল তখনও মক্কায় কাফির অবস্থায় জীবিত। হযরত আবদুল্লাহ রা: পিতার জন্য রাসুলুল্লাহ সা: এর নিকট আমান বা নিরাপত্তা চাইলেন। এ সম্পর্কে তার পিতা সুহাইল বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সা: যখন মক্কায় প্রবেশ করেন, আমি আমার ঘরে প্রবেশ করে দরযা বন্ধ করে দিলাম।

তারপর আমার ছেলে আবদুল্লাহকে আমার নিরাপত্তার আবেদন জানানোর জন্য মুহাম্মাদের সা: নিকট পাঠালাম। কারণ, আমি যে নিহত হবোনা, এমন বিশ্বাস আমার ছিল না। আবদুল্লাহ রাসুলুল্লাহর সা: নিকট গিয়ে বললো, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমার পিতাকে কি আমান বা নিরাপত্তা দান করছেন?’ রাসুলুল্লাহ সা: বললেন: ‘হাঁ।

তাকে আল্লাহর আমানে আমান বা নিরাপত্তা দেওয়া গেল। সে আত্মপ্রকাশ করুক।’ অত:পর রাসুলুল্লাহ সা: তার আশে পাশের লোকদের বললেন, ‘সুহাইল ইবন আমরকে কেউ যেন হেয় চোখে না দেখে। আল্লাহর কসম, সে একজন সম্মানী ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি। এমন ব্যক্তি কক্ষণো ইসলামের সৌন্দর্য থেকে অজ্ঞ থাকতে পারে না। এখন তো সে দেখতে পেয়েছে, সে যার সাহায্যকারী ছিল তাতে কোন কল্যাণ নেই।’

হযরত আবদুল্লাহ রা: পিতার নিকট উপস্থিত হয়ে রাসুলুল্লাহ’র সা: নির্দেশ শুনিয়ে সুসংবাদ দিলেন। পিতা পুত্রের সৌভাগ্যে আনন্দে বিগলিত হয়ে বলে ওঠেন, ‘ আল্রাহর কসম, তুমি ছোটবেলা ও বড় হয়ে উভয় জীবনে সতকর্মশীল।’ রাসুলুল্লাহ সা: এ আশ্বাসের পর সুহাইল দ্বিধা-দ্বন্দ্বে দোদুল্যমান অবস্থায় তাঁর দরবারে হাজির হন।

হুনাইন যুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে রাসুলুল্লাহ সা: সাথে মক্কা থেকে রওয়ানা হন। পথে মক্কার অনতিদূরে ‘জি’রানা’ নামক স্থানে পৌঁছে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। হযরত রাসূলে কারীম সা: হুনাইনের গণীমত থেকে তাঁকে ১০০ (একশো) উট দান করেন। (হায়াতুস সাহাবা-১/১৭৩-১৭৪)।

খলীফা আবু বকর সিদ্দীক রা: এর খিলাফত কালে আরব উপদ্বীপে যাকাত অস্বীকারকারী ও ভন্ড নবীদের যে বিদ্রোহ দেখা দেয়, হযরত আবদুল্লাহ রা: সেই বিদ্রোহ দমনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। হিজরী ১২ সনে ইয়ামামার প্রান্তরে ভন্ড নবী মুসাইলামার সাথে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়, আবদুল্লাহ সেখানেই শাহাদত বরণ করেন। সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতানুসারে মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র আটত্রিশ বছর।

আবদুল্লাহর রা: পিতা সুহাইল তখনও মক্কায় জীবিত। এ ঘটনার পর খলীফা হযরত আবু বকর রা: হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কায় আসেন। তিনি আবদুল্লাহর পিতার সাথে দেখা করে তাঁকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্ঠা করেন। আবদুল্লাহর পিতা খলীফাকে বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সা: বলেছেন, একজন শহীদ ব্যক্তি তার পরিবারের সত্তর (৭০) জনের শাফায়াত বা সুপারিশ করবে। আমার আশা আছে, সে সময় আমার ছেলে ‍আমাকে ভুলবে না।

যায়িদ ইবনুল খাত্তাব (রা:)

নাম যায়িদ, ডাক নাম আবু আবদির রহমান। পিতা খাত্তাব ইবন নুফাইল, মাতা আসমা বিনতু ওয়াহাব। হযরত উমার ইবনুল খাত্তাবের বৈমাত্রীয় ভাই এবং বয়সে হযরত উমার থেকে বড়। (উসুদুল গাবা-২/২২৮)।

ইসলামের সূচনা পর্বে উমারের বাড়াবাড়ির কারণে যদিও খাত্তাবের বাড়ী সন্ত্রস্ত ছিল, তথাপি যায়িদ উমারের পূর্বেই ইসলাম কবুল করেন এবং মুহাজিরদের প্রথম কাফিলার সাথে মদীনায় হিজরাতও করেন। হযরত রাসূলে কারীম সা: মদীনায় আসার পর মা’ন ইবন ’আদী আল ’আজলানীর সাথে তার মুওয়াখাত বা ভাতৃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে দেন।

মদীনায় আসার পর সর্বপ্রথম ‘বদর’ যুদ্ধে শরীক হন। তারপর উহুদেও অংশ গ্রহণ করেন। দারুন ‍সাহসী ছিলেন। প্রত্যেক যুদ্ধে তিনি যতটা না বিজয় কামনা করতেন তার চেয়ে বেশি কামনা করতেন শাহাদাত। উহুদে তিনি অসীম সাহসের সাথে লড়ছেন। এমন সময় তার ভাই উমার লক্ষ্য করলেন যায়িদের বর্মটি খুলে পড়ে গেছে এবং সে দিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই।

তিনি নাঙ্গা শরীরে শত্রু বাহিনীর মাঝখানে ঢুকে পড়ছেন। উমার ভাইকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি চিতকার করে ভাইকে ডেকে বললেন, ‘খুজ দিরয়ী’ ইয়া যায়িদ, ফা কাতিল বিহা’- যায়িদ, এই নাও আমার বর্মটি। এটি পরে যুদ্ধ কর।’

যায়িদ উত্তর দিলেন, ‘ইন্নী উরীদু মিনাশ ‍শাহাদাতি মা তুরীদুহু ইয়া উমার’-ওহে উমার, তোমার মত আমারও তো শাহাদাতের সুমধুর পানীয় পান করার আকাংখা আছে।’ তারপর দুজনেই বর্ম ছাড়াই যুদ্ধ করেন। (তাবাকাত ইবন সা’দ-৩/২৭৫. হায়াতুস সাহাব-১/৫১৫, রিজালুন হাওলার রাসূল-৩৪৪)।

তিনি হুদাইবিয়ার ঘটনায় উপস্থিত ছিলেন এবং হযরত রাসূলে কারীমের সা: হাতে বাইয়াত করেন। তাছাড়া খন্দক, হুনাইন আওতাস প্রভৃতি যুদ্ধেও তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। বিদায় হজ্জেও তিনি রাসুল্লাহর সা: সফরসঙ্গী ছিলেন। এ সফরেই তিনি রাসুলুল্লাহর সা: এ বাণী শোনেন, ‘তোমরা যা নিজেরা খাও, পর, তাই তোমাদের দাস দাসীদের খাওয়াও, পরাও। যদি তারা কোন অপরাধ করে, আর তোমরা তা ক্ষমা করতে না পার, তাহলে তাকে বিক্রি করে দাও।’ (তাবাকাত-৩/২৭৪)।

হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা: খিলাফতকালে ধর্মদ্রোহীদের যে ফিতনা বা অশান্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তা নির্মূলের জন্য হযরত যায়িদ অন্যদের সাথে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং অনেক মুরতাদকে তিনি স্বহস্তে হত্যা করেন। বিখ্যাত মুরতাদ নাহার ইবন উনফুহ যার ইসলাম ত্যাগ করা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সা: তার মুসলমান থাকাকালেই ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন, তাকে হযরত যায়িদ নিজ হাতে খতম করেন।

মুসাইলামা কাজ্জাবের সাথে ইয়ামামার যুদ্ধে ইসলামী ঝান্ডা বহনের দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। যুদ্ধ চলাকালে বনু হানীফা একবার এমন মারাত্মক আক্রমণ চালায় যে, মুসলিম বাহিনী পরজায়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। কিছু সৈনিক তো যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যায়। এতে যায়িদের সাহস আরও বেড়ে যায়। তিনি চিৎকার করে সাথীদের আহবান জানিয়ে বলতে লাগলেন, ‘ওহে জনমন্ডলী, তোমরা দাঁত কামড়ে ধরে শত্রু নিধন কার্য চালিয়ে যাও।

তোমরা সুদৃঢ় থাক। আল্লাহর কসম, আল্লাহ তাদের পরাজিত না করা অথবা আমি আল্লাহর সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত কোন কথা আমি বলবো না। আল্লাহর সাথে মিলিত হলে সেখানেই আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করে কথা বলবো।’ (রিজালুন হাওলার রাসূল-৩৪৫)।

তারপর তিনি সংগী সাথীদের ভুলের জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে বলতে থাকেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আ’তাজিরু ইলাইকা মিন মিরারে আসহাবী’- হে আল্লাহ, আমার সংগী সাথীদের ভেগে যাওয়ায় আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই।’ (হায়াতুস সাহাবা-১/৫৩৪-৩৫)। এ অবস্থায় তিনি পতাকা দুলিয়ে শত্রু বাহিনীর ব্যুহ ভেদ করে চলে যান এবং তরবারী চালাতে চালাতে শাহাদত বরণ করেন। তাঁর শাহাদাতের পর সালেম রা: পতাকা তুলে নেন। হযরত ‍যায়িদের মৃত্যু সন হিজরী ১২। (আল ইসাবা -১/৫৬৫)।

হযরত যায়িদ ছিলেন হযরত উমারের রা: অতি প্রিয়জন। তাঁর মৃত্যুতে হযরত উমার অত্যন্ত শোকাভিভূত হয়ে পড়েন। তাঁর সামনে কোন মুসীবত উপস্থিত হলেই তিনি বলতেন, যায়িদের মৃত্যুশোক আমি পেয়েছি এবং সবর করেছি।’ যায়িদের হত্যাকারীকে দেখে উমার রা: বলেন, ‘তোমার সর্বনাশ হোক, তুমি আমার ভাইকে হত্যা করেছো।

প্রভাতের পূবালী বায়ু তারই স্মৃতি নিয়ে আসে।’ (হায়াতুস সাহাবা-২/৫৯২) এত প্রিয় ভায়ের মৃত্যুশোকে তিনি কিন্তু দিশেহারা হয়ে পড়েননি। মদীনায় খলীফা আবু বকরের সা: সাথে তিনি ইয়ামামা প্রত্যাগত সৈনিকদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলেন। তাদের কাছে ভায়ের শাহাদাতের খবর শুনে তিনি বলে ওঠেন, ‘সাবাকানী ইলাল হুসনাইন আসলামা কাবলী ওয়া ইসতাশহাদা কাবলী’- দুটি নেক কাজে তিনি আমার থেকে অগ্রগামী রয়ে গেলেন- আমার আগেই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং আমার আগে শাহাদাতও বরণ করলেন।” (আল ইসাবা-১/৫৬৫)।

ঠিক এই সময় আরবের ততকালীন এক বিখ্যাত কবি মুতাম্মিম ইবন নুওয়াইরার এক ভাইও একটি যুদ্ধে খালিদ ইবনুল ওয়ালীদের হাতে নিহত হয়। কবি মুতাম্মিম তার ভাইকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি মৃত ভায়ের স্মরণে এমন এক করুণ মরসিয়া রচনা করেন যে, তা শুনে শ্রোতাদের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো।

ঘটনাক্রমে হযরত উমারের রা: সাথে কবির সাক্ষাত হয়। উমার রা: তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি তোমার ভায়ের মৃত্যুতে কতখানি শোক পেয়েছো?’ কবি বললেন, ‘কোন এক রোগে আমার একটি চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে শুরু করে আজ পর্যন্ত তা আর বন্ধ হয়নি।’ তার কথা শুনে হযরত উমার মন্তব্য করেন, ‘শোক দু:খের এটাই হচ্ছে চূড়ান্ত পর্যায়।

যে চলে যায় তার জন্য কেউ এতখানি ব্যাথাতুর হয় না।’ তারপর তিনি বলেন, ‘আল্লাহ যায়িদকে ক্ষমা করুন। যদি আমি কবি হতাম তার জন্য আমি মরসিয়া রচনা করতাম।’ এ কথা শুনে কবি মুতাম্মিম বলে ওঠেন, ‘আমীরুল মু’মিনীন, যদি আপনার ভায়ের মত আমার ভাই শহীদ হতো, আমি কক্ষনো অশ্রু বিসর্জন করতাম না।’

কবির এ কথায় হযরত উমার রা: অনেকটা সান্তনা লাভ করেন। তারপর তিনি বলেন, এর থেকে উত্তম সান্তনা বাণী আর কেউ আমাকে শুনায়নি।’ বিভিন্ন ব্যক্তি হযরত যায়িদ ইবনুল খাত্তাব থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন।